• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
মানবতা ও সমাজ সংস্কারের প্রাণপুরুষ ফকির লালন শাহ্

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

মানবতা ও সমাজ সংস্কারের প্রাণপুরুষ ফকির লালন শাহ্

  • অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  • প্রকাশিত ১২ মার্চ ২০২০

লালনের গানে তার অনুসারীরা খুঁজে পান অমৃতের সন্ধান। মানবজীবনের মোহমায়া, ভোগলিপ্সা থেকে মুক্ত হয়ে পরমার্থের জন্য মহাজনেরা যুগে যুগে, দেশে দেশে কঠিন সাধনায় আত্মনিবেদন করেছেন। বহুজনের বহুমত, বহুপথ। লালন বলেছেন মানবধর্মের কথা। অমৃতের সন্ধান করেছেন আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। সেই অমৃতের সন্ধানেই সাঁইজির ধামে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী, অনুসারীরা ছুটে আসেন।

কে এই লালন, কী তার জাতপরিচয় অথবা কেমন তার ধর্ম-জীবনপ্রণালি, প্রশ্ন জাগে। মানুষের মতামতের যেমন শেষ নেই, তেমনি গবেষকরাও তার সব বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। অথচ ১৩০ বছর আগে দেহত্যাগী লালনের একজোড়া গুরু-শিষ্যকে ধরে নেমে এলেই জীবিত বাউলের দেখা মেলে। যেহেতু বাউলবাদ গুরুবাদী, সেহেতু গুরু-শিষ্যের সরেজমিন কথোপকথন, জীবন, যৌনাচার সবকিছুর বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যাবে সম্যক লালন ও তাঁর দর্শনকে। কার্তিক এলেই আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদনৃত্যে ভারী হয়ে ওঠে সাধুবাজার। গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে শুরু হয় ভাবের খেলা। ভাবজগতের মধ্যে বেজে ওঠে— ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে’। একতারা, দোতরা, ঢোলখোল, হারমনি, বাঁশি, জোয়ারি, চাকতি, খমক হাতে একযোগে বাউলরা উড়াল তোলে। শোক-বিয়োগের দিন হলেও ভক্তভারে ক্রমেই দৃশ্যগুলো তখন পাল্টে যেতে শুরু করে। খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে তালের উন্মাদনায় দমকে দমকে ভাসতে থাকে ভাববাদী ঢেউ। স্মরণোৎসব শোকাচ্ছন্ন থাকে না, উল্টো আনন্দময় মচ্ছবে পরিণত হয়। দুটো বড় আয়োজন বাদেও প্রায় প্রতিদিনই সাধু-গুরুদের বাজার বসে আখড়াবাড়িতে। সাধুবাজারেই পাওয়া যায় বাউলিয়ানার সরেজমিন আচারনিষ্ঠা এবং সাধন-ভজনের স্বরূপ বৃত্তান্ত। পরিবেশনার আঙ্গিক যেমনই হোক না কেন, গানগুলো সব একজনেরই। ভক্তের কাছে তিনি দীক্ষাগুরু। সাধারণ শ্রোতার কাছে বাউলসম্রাট, বিদগ্ধজনের কাছে বাংলার লোকসংগীত ও মরমি দর্শনের অন্যতম দিকপাল লালন সাঁই। সাধুদের আধ্যাত্মিক চর্চার অনুষঙ্গ হিসেবে শুরু হওয়া এই আয়োজন এখন নানা দেশ, নানা শ্রেণি-পেশার, নানা বয়সী নর-নারীর বিপুল সমারোহে এক বিশাল বিচিত্র কর্মযজ্ঞ।

লালনকে বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই তার সমকালীন সমাজকে জানতে হবে। সমাজে যখন জাতিভেদ প্রথার ছোঁয়াছুঁয়ির কবলে পড়ে নীচুতলার মানুষ ঊণমানবে পরিণত হয়ে মুক্তির আকুতি নিয়ে আকুলিবিকুলি করছিল, কিন্তু প্রতিবাদের অস্ফুট স্বর কণ্ঠ পেরিয়ে মুখে আসছিল না; লালন তখন এই জাতপাতের ওপর খড়্গ ধরলেন এবং তাদের মুখে ভাষা দিলেন। তিনি বলিষ্ঠভাবে সমাজ আরোপিত জাতপাতকে অস্বীকার করে ঘোষণা করলেন, ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা/সত্য পথে কেউ নয় রাজি সব দেখি তা না না।।/যখন তুমি ভবে এলে/তখন তুমি কি জাত ছিলে/কি জাত হবা যাবার কালে/সেই কথা ভেবে বলো না।।/ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি/এক জলেই সব হয় গো শুচি/দেখে শুনে হয় না রুচি/যমে তো কাউকেই থুবে না।।/গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে কি ধর্মের ক্ষতি হয়/লালন বলে জাত কারে কয় এ ভ্রম তো গেল না।।’

সমকালীন সমাজে জাতিভেদপ্রথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজকে বিষিয়ে তুলছিল। কী হিন্দু কী মুসলিম উভয় সমাজেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। জাতিভেদপ্রথা এতটাই প্রকট ছিল এবং সমাজে বিভেদের প্রকার তুলেছিল যে নীচজাতের লোকদের সঙ্গে উঁচু জাতের লোকেরা খাওয়া-ওঠাবসা করত না। একের ছোঁয়ায় অন্যে অপবিত্র হয়ে যেত। ছোঁয়াছুঁয়ির এই ভেদবিভেদের মধ্যে পড়ে একই সমাজের মধ্যে নানা উপসমাজের তৈরি হয়েছিল এবং সমাজের নীচুতলার মানুষ প্রকারান্তরে সমাজের মূলস্রোত থেকে ছিল অনেকটা নির্বাসিত। এই পরিস্থিতিতে লালন এসে ঘোষণা করলেন, সমাজ কর্তৃক মানুষে মানুষে বিভাজন ঠিক নয়। কারণ, সমাজের বর্ণভেদ প্রথার মারপ্যাঁচে পড়ে বিভক্ত শ্রেণি ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার-মুচির মধ্যে প্রভেদ নেই। কারণ, বিধাতার রাজ্যে সবাই সমান। সবার জন্য বিধাতার একই বিধান। সুতরাং সমাজের সুবিধাবাদী গ্রুপের সৃষ্টি জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, ভেঙে ফেলতে হবে সমাজের এই কুসংস্কার। আর সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের আন্দোলন করতে গিয়ে লালন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ ধর্মের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে চিহ্নসর্বস্ব ধর্মের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং সমাজবদলের সংগ্রামে লালন চিহ্নসর্বস্ব ধর্মকে অস্বীকার করেছেন দৃঢ়কণ্ঠে, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কীরূপ দেখলাম না এই নজরে।।/কেউ মালা কেউ তজবি গলায়/তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়/যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।/যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/তবে নারী লোকের কি হয় বিধান/ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ/ব্রাহ্মণী চিনি কিসে রে।।/জগৎজুড়ে জাতের কথা/লোকে গর্ব করে যথাতথা/লালন কয় জাতের ফ্যাতা/ডুবাইছি সাত বাজারে।।’

লালনের এই উচ্চচারণকে যদি আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখি, তবে লালনের সাহসের সত্যিই তারিফ করতে হয়। লালন ধর্মীয় কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজকাঠামোতে আঘাত করতে গিয়ে সমাজের সবচেয়ে সেনসেটিভ ইস্যু ‘ধর্ম’ ও ‘নারী’—এই দুটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা আজকের এই অধিকতর সেক্যুলার সময়ে এসেও আমাদের বোধের অতীত। কিন্তু সেই উনবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সময়ে বসে লালনের এই স্পর্ধা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে। লালন শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের কাঠামো পরিবর্তন না করলে সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। তাই তিনি ভারতীয় সমাজের মৌল কাঠামোর ওপর নির্মম আঘাত হেনেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে, যা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সাহস করি না। তিনি মুসলমান ধর্মের চৈহ্নিক অসারতার কথা বলতে গিয়ে খতনার কথা বলেছেন এবং সেই বলাটাকে তীক্ষতা দিতে গিয়ে তিনি মুসলমান নারীসমাজের অবতারণা করেছেন। আর সমভাবে হিন্দুসমাজের নারীদের কথাও পেড়েছেন তীক্ষ প্রশ্নের বাণে। লালনের সময়ে গ্রামীণ সমাজ ছিল অত্যন্ত কুসংস্কারযুক্ত এবং রক্ষণশীল। সেই রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস তার সময়ে কেউ দেখাননি। কিন্তু লালন সেই কাজটিই করেছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। কারণ, তিনি জানতেন যে সমাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে হলে, সমাজের কাঠামো বদল করতে হলে সেই কাঠামোর ওপরই আগে আঘাত করতে হবে। লালন সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নিজের সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন। তিনি নিজের সামাজিক পরিচিতি তথা সাম্প্রদায়িক পরিচিতির ব্যাপারে অবলীলায় বলেছেন, ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু না যবন/লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।।’

লালনের গানে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তার দর্শনের যে প্রতিফলন দেখা যায়, তা দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমানবিক মূল্যবোধের পরিচয় তুলে ধরে। লালন তাই কেবল বাঙালি মরমি কবি বা গীতিকবিদের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন, বিশ্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গনেও তার অবস্থান অনেক উঁচুতে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে জাতধর্মের বাহ্যিক আচরণ ও ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লালন ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার গান জাতপাতের বিরুদ্ধে মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়। গানে তিনি বলছেন, ‘একই ঘাটে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া/কেউ খায় না কারও ছোঁয়া বিভিন্ন জল কে কোথায় পান।’

বাংলার বাউল ধর্মমতের শুরু মধ্যযুগে। গবেষকদের মতভেদ রয়েছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, বাউলধর্মের সূত্রপাত আনুমানিক ১৬২৫ সালের দিকে। আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন, উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ। লালন সাঁইয়ের বাউলতত্ত্ব পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবধর্মনির্ভর। যদিও সব বাউলেরই একই পথ, তবু বাংলার ঐতিহ্য, চিন্তাধারা, সমাজব্যবস্থার সুর পুরোপুরিই পাওয়া যায় লালনের গানে। অধ্যাত্ম চেতনা আর ঐশ্বর্যের মাধুর্যে লালন সাঁই যে মরমি জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন আজ তার মানবলীলা সংবরণের ১২৬ বছর পরও তার গানের চেতনায় ভাটা পড়েনি বরং চর্যাপদের মতো তার গানের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি দিনের পর দিন মানুষের বোধকে ত্বরান্বিত করেছে। আর তা চিরভাস্বর সাম্যবাদিতা আর অসাম্প্রদায়িকতার দিকেই ধাবিত। জাতভেদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালন সাঁইর গান এক নীরব মূলমন্ত্র, চেতনার শাণিত মারণাস্ত্র।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads