• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বইয়ের চাপে আনন্দহীন শিশুর জীবন

  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০২০

রায়হান আহমেদ তপাদার

 

 

শিক্ষা ক্ষেত্রে আজ চলছে এক অসুস্থ ও অসম প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় কয়েক ধাপ এগিয়ে কিন্ডারগার্টেন আর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো। দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকার পরও এসব শিশুকে দেওয়া হয় হোমওয়ার্ক বা বাড়ির কাজ। একদিকে পাহাড়সম সিলেবাস আর অন্যদিকে প্রতিদিন বাড়ির কাজ শেষ করার চাপে চিড়েচ্যাপটা অবস্থা। কিছুটা সচেতন পরিবারগুলোয়ও দেখা যায়, রোজ সন্ধ্যায় এসব কোমলমতি শিশুকে পড়াতে বসান তাদের মা-বাবা, বিশেষ করে মায়েরা। আর সেই মা যদি একজন কর্মজীবী মা হন, তাহলে তো কথাই নেই। শিশুদের পড়া শেষ করানোর এই গুরুদায়িত্ব তার জন্য যে কতখানি ক্লান্তিকর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা দিনের কর্মক্লান্তির পর তার উদ্যম যখন প্রায় ফুরিয়ে আসছে, তখন তাকে নব উদ্যমে নিয়োজিত হতে হয় সন্তানকে শিক্ষিত করার মহান দায়িত্ব পালনে। কেউ কেউ আবার সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠিয়েও সান্ত্বনা খোঁজেন। ভারী ব্যাগের অর্থ কিন্তু শুধুই বইয়ের বোঝা নয়, বরং এ বোঝা দায়িত্বেরও। এই দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে কাঁধে করে বয়ে না বেড়ানোই কেবল এ দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণের ইঙ্গিত বহন করে না। তাই চক্ষুর গোচরে এবং চক্ষুর অগোচরে অতিরিক্ত দায়িত্বের দায়ভার থেকে কোমলমতি শিশুদের মুক্তি প্রদানে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে।

শিশুরা হাঁটাচলা কিংবা নিজেদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল আয়ত্ত করার আগেই শিখছে দায়িত্ব বহন করার জটিল কৌশল। অতিরিক্ত ভারী বোঝা বহন করা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, আমরা সবাই জানি। অনেক মা-বাবাকেই দেখি এগিয়ে আসেন সন্তানের সাহায্যে। এক হাতে সন্তান আর অন্য হাতে সন্তানের ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে চলেন স্কুলমুখে। ইদানীং ট্রলিব্যাগের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। তাই বইয়ের বোঝা শারীরিকভাবে বহন করার জন্য হয়তো বিকল্প কিছু পথও রয়েছে। কিন্তু মানসিক চাপের বোঝা বহনের বিকল্প পথ খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন। তাই অতিরিক্ত দায়িত্বের ভারে জর্জরিত শিশুর মনস্তাত্ত্বিক জগৎ লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায়। সে বোঝা বইবে কে? হাইকোর্টের রায় কিংবা সরকারের প্রণীত সার্কুলার শিশুদের মনোজগতের ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী বোঝা অপসারণে সফল হবে তো! শিশুদের এখন প্রতিনিয়ত বই-খাতার বিশাল ব্যাগ বহন করতে হচ্ছে। অসংখ্য পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে হাফ ডজন পর্যন্ত অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর। রাজধানীর প্রতিটি স্কুলের পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও এমন দৃশ্য আজ আর নতুন নয়। বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে চলতে দেওয়ায় মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। তাই শিশুদের কাঁধে অতিরিক্ত বইয়ের চাপ কমিয়ে সুষ্ঠু মানসিকতায় পড়ালেখা করতে সহযোগিতা করা প্রতিটি অভিভাবকের দায়িত্ব। শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের ভার কমানোর আবারো নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, শিশুদের এই ভার থেকে মুক্ত করতে হবে। তারা যেন খেলাধুলা করতে পারে, সেই সুযোগ করে দিতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের প্রথম দিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেওয়ার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক ২০২০ সালে কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হবে। ২০২১ সাল থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষার পরিবর্তে নিবিড় মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হবে। অথচ কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিশুদের এ মূল্যায়ন ব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে কি না, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। শিশুদের মধ্যে বৈষম্য থাকলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হ্রাস পেয়ে সরকারি অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কারণ আমাদের দেশের জনগণ, শিক্ষার্থী সবাই পরীক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। এক কথায় বলতে গেলে, তারা পরীক্ষাপাগল। আমাদের দেশের শিক্ষক, অভিভাবক ও জনগণের উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। পরীক্ষার পাসে সবাই আত্মহারা হয়ে মিষ্টি বিক্রেতাদের লাভবান করেন। এ পরীক্ষায় আরো লাভবান হয় কোচিং সেন্টারসহ নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা। আমাদের পরীক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট সিলেবাস, অধ্যায় বা কতিপয় প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ পরীক্ষাব্যবস্থা অনেকটা ডাক্তারি শিক্ষায় সামান্য জ্ঞানের হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো। ডিগ্রিধারী চিকিৎসক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থা সার্বিক জ্ঞান যাচাই করে জ্ঞাননির্ভর করতে হবে। বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় একটুখানি এদিক-সেদিক প্রশ্ন হলে এ পাস বাবু-মাঝির কবিতার মতো ষোলোআনাই মিছে হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় এই বড় বড় জিপিএ-৫ পেয়েও উত্তীর্ণ হতে পারে না। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সব ধরনের শিক্ষা দেবেন এবং মূল্যায়ন করবেন। ঘাটতি থাকলে তা পূরণের ব্যবস্থা করবেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীকে শোনা, বলা, পড়া, লেখার যোগ্যতার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, সুঅভ্যাস গঠন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, গরিব শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা— এক কথায় পরিপূর্ণ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে জবাবদিহিতার আওতায় এনে পর্যাপ্ত শিক্ষক, পাঠদানবহির্ভূত কাজ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। কর্মকর্তাসহ ম্যানেজিং কমিটির অহেতুক খবরদারি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস থেকে উন্নত বিশ্বের মতো ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যেতে হবে? তাদের মর্যাদা থাকবে সবার ওপরে। প্রধানমন্ত্রী শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর কথা প্রায়ই বলে থাকেন। এ নির্দেশনা কার্যকরের দায়িত্ব হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মহামান্য হাইকোর্ট এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি স্কুলে বইয়ের বোঝা বেড়েই চলেছে। বইয়ের বোঝা কমানোর বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শিশুদের বিকালবেলা খেলাধুলার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আবার আরেকটি বাস্তব চিত্র হলো, স্কুলগুলোর সিলেবাসকে আরো স্বাস্থ্যবান বানানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন কিছু অতি উৎসাহী অভিভাবক। তাদের প্রবণতা হলো, তারা হরহামেশা এক স্কুলের সিলেবাসের সঙ্গে আরেক স্কুলের সিলেবাসের তুলনা করেন। ভাবেন, পড়া চাপিয়ে দিলেই বুঝি শিশুরা তা শেষ করতে পারবে।

শিশুরা হয়তো অনেক কিছুই সহজে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটি কতটুকু স্বাস্থ্যকর, বিষয়টি ভাবতে হবে। তাই শুধু স্কুলগুলোয় এ ধরনের সার্কুলার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেই চলবে না, বরং পর্দার অন্তরালে প্রকৃত ঘটনার অনুসন্ধানও করতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে মানসিকতা পরিবর্তন করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে আইনের যথাযথভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের অতিরিক্ত পড়ার বোঝা যেন বাসা, কোচিং সেন্টার বা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত না হয়, সে বিষয়ে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। পাঠ্যবইয়ের সহায়ক বইগুলোর আবির্ভাব যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, সে বিষয়েও কদারকি জরুরি। পড়ার বইয়ের বোঝার চাপ কমানোর পাশাপাশি আরো যা প্রয়োজন তা হচ্ছে— ভালো ফল করার উগ্র প্রতিযোগিতার চাপ হ্রাস করা। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হোক মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ ও আলোকিত মানুষ গঠন; শুধু ভালো ফল প্রদানকারী যন্ত্রমানব তৈরি যেন উদ্দেশ্য না হয়।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রবাসী লেখক

raihan567@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads