• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রাথমিকে প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন 

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

প্রাথমিকে প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন 

  • গোপাল অধিকারী
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০২০

শিক্ষা। মানবিক গুণসমৃদ্ধ যা কিছু অর্জন তাই আমার কাছে শিক্ষা। আর প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে যে শিক্ষা অর্জন করে তা-ই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে যে বিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী শিক্ষা অর্জন করে, তা-ই প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা। একটা সময় ছিল, এই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পাড়ি দিতে হতো দীর্ঘ পথ। তৎকালীন সময়ে যে কারণে শিক্ষার হার ছিল নগণ্য। বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রী ছিল সংখ্যায় কম। শিক্ষক ছিল অপ্রতুল। বই কিনতে হতো অর্থ দিয়ে লাইব্রেরি থেকে। ফলে দারিদ্র্যের কারণে ঝরে পড়ত অনেক শিক্ষার্থী। সবকিছু মিলিয়ে পড়ালেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল কম। বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষক রয়েছে পর্যাপ্তসংখ্যক। বই দেওয়া হচ্ছে সরকার থেকে বিনামূল্যে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে এখন বিদ্যালয়মুখী। তা ছাড়া পড়ালেখার ব্যাপারে এখন অনেক পরিবারই সচেতন। সন্তানের পড়ালেখা করাতে অনেক পরিবারই দরিদ্রতাকে জয় করছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক থেকেই গুরুত্বসহকারে তৈরি করছেন। আমাদের সময় যে যত্নটার অভাব ছিল, বর্তমান সময়ে সেই যত্নটা প্রাক-প্রাথমিক থেকেই পাচ্ছে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। আর কেনই বা করবে না, একটি বাড়ির ভিত্তি যদি মজবুত না থাকে, তাহলে সেই বাড়ি কিন্তু বেশি দূর পর্যন্ত উঁচু করা যাবে না। ঠিক তেমনি একটি সন্তানকে যদি শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই যত্ন না করা যায় তাহলে তারা রত্ন হবে না।

তাই প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার মূলভিত্তি। এই সময়ে অভিভাবকদের উচিত মানসম্মতভাবে গড়ে তোলা এবং গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া ও সন্তানের যত্ন নেওয়া। আর সেই কারণে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারপরও কিছু অসচেতন অভিভাবক আছেন, যারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না বা শিক্ষার মর্মটা উপলব্ধি করেন না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম দিনে দেশের ৪ কোটি ২০ লাখেরও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫,৩১,৪৪,৫৫৪টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৫টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলফলক। বর্তমান সরকার শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। এ ছাড়াও চালু রয়েছে বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা। সরকারি শিক্ষকদের বেতন হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু যত সুবিধা দিচ্ছে তার থেকে ভালোটা কম পাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। শিক্ষার দিক থেকে যদি বলি, তবে সবকিছুর মধ্যেও দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কিছু ঘাটতি রয়েছে। দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নতি করাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। আবার মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও মানসম্মত উন্নতি করাতে পারছে না। আর কেজি স্কুলগুলো সেই সুযোগটা লুফে নিচ্ছে।

তবে আগের প্রাথমিকের কিছু চিত্র বর্তমানে অনেকাংশে কমেছে। আগে যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ক্লাস হতো না। শিক্ষিকাদের ক্লাসে না গিয়ে মাঠে বসে রোদ পোহাতে দেখা যেত। শিক্ষকদের ক্লাস না করে ক্লাস চলাকালীন বাজার করতে দেখা যেত। বর্তমানে তা বহুলাংশে কমেছে। এখন যে বিষয়গুলো ঘাটতি বলে চিহ্নিত, তা হলো—এক ক্লাসে অধিক ছাত্রছাত্রী; শিক্ষার্থী অনুপাতে ক্লাসের সময়সীমা স্বল্প; শিক্ষকদের যোগ্যতা; এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। সরকার বই প্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ দিলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী রয়েছে অধিক পরিমাণে। যার ফলে শিক্ষকরা যথাযথভাবে ক্লাস নিতে পারছেন না। উদাহরণ—পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার এয়ারপোর্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য থেকে জানতে পারি, সেখানে একটি শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৮৬ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তার বিপরীতে ক্লাসের সময় ৫৫ মিনিট। একজন শিক্ষার্থীর জন্য ১ মিনিট করে যদি পড়া ধরা হয়, সেখানে সময় লাগবে ৮৬ মিনিট। এর সঙ্গে শিক্ষককে পড়াটা বোঝানোর একটা ব্যাপার থাকে। লেখানো ও লেখা দেখার একটি বিষয় থাকে। কারণ, অনেক অভিভাবকই বাড়িতে গেলে শ্রেণির কাজ দেখতে চান। এমতাবস্থায় কীভাবে শিক্ষকরা পড়াটা বুঝিয়ে যাচাই-বাছাই করবেন বা লেখাবেন? অভিভাবকদের আবেদন কিন্তু থাকে যে, শিক্ষক প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন ধরবেন। এখন যদি শ্রেণিকে স্বল্প শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করা যায় অথবা ক্লাসের সময় বাড়ানো যায়, তবেই পড়াটা বা ক্লাসটা আরও কার্যকর হতো।

আবার স্বল্পসময়ে শিক্ষকরা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছেন না বলে বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট পড়াতে। আর অভিভাবকরাও বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেটে দিতে। অন্যদিকে বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির যে সিলেবাস বা প্রশ্নকাঠামো তাতে একটি দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক প্রয়োজন। বিভিন্ন শিক্ষকের মন্তব্য থেকে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়টি তুলনামূলক জেএসসি থেকে কঠিন। কিন্তু সেখানে অনেক শিক্ষিকা রয়েছেন যারা এসএসসি পাস। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের যোগ্যতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। একসময় সৃজনশীল ছিল না বা পড়ালেখার কারিকুলাম এমন ছিল যে, সেই সময়ের জন্য তারা উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে তাদের যোগ্যতার ঘাটতিটুকু আমাদের মেনে নিতে হবে। ইংরেজি ও গণিতে ভালো করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। আর প্রাথমিকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। এ বছর বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছি— কারণ এখনো প্রশ্নকাঠামো দেওয়া হয়নি বা ২০২১ সালের বই তৈরির কাজ হয়তো এখনো শুরু হয়নি। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা প্রশ্নকাঠামোর দিকে তাকালে লক্ষ করা যায়, সেখানে কিছু অংশ পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত। যদি বাংলার বিষয়ে বলি, সেখানে রয়েছে বিরামচিহ্ন। অথচ বিরামচিহ্নের যে নিয়মটা রয়েছে—কোথায় কী থাকলে কোন চিহ্ন হয়, তা পাঠ্যপুস্তকে নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করছে। ইংরেজির প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশ থাকে পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো গ্রামার নাই অথচ পরীক্ষাতে আসছে ‘ডব্লিউ এইচ  কোশ্চেন’। এটা করতে গেলে সাবজেক্ট, নাম্বার, ভারব, টেন্স জানা দরকার। এগুলো না পড়িয়ে ‘রি-অ্যারেঞ্জ’ বা ‘ডব্লিউ এইচ কোশ্চেন’ করালে ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, এটাই তো সত্য। তা ছাড়া যেখানে টেন্স শেখানো হচ্ছে না সেখানে আনসিন প্যাসেজ দিলে কীভাবে লেখা সম্ভব? ধাপে ধাপে না শেখালে ভিত্তি কীভাবে মজবুত হবে?

সুতরাং তৃতীয় শ্রেণি থেকে কিছু কিছু গ্রামার যোগ করা দরকার। তা ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন আসে; কিন্তু কোনো অধ্যায়েই সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা নেই। আগে কেমন প্রশ্ন হবে তার নমুনা দেওয়া হতো, অথচ এখন কেন নেই? তাতে কি গাইড বিক্রেতাকে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে না? নমুনা দিলে কি খুব ক্ষতি হতো? জানি, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি অতি দক্ষ ও মেধাবী, তবু আমার স্বল্প মেধায় একজন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এই বিষয়গুলো আমার কাছে পরিবর্তন বা সংযোজন প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এবং যে সৃজনশীলতা নিয়ে জাতি গঠনে এগিয়ে চলছে তাতে পাঠ্যপুস্তকসংশ্লিষ্ট প্রশ্নকাঠামো করলে উদ্দেশ্য বেগবান হবে। ফলাফল আরও সুন্দর হবে। সর্বোপরি সৃজনশীলতা এগিয়ে যাবে বলে বোধ হচ্ছে।

তাই হয় পাঠ্যপুস্তক নয়তো প্রশ্নকাঠামো পরিবর্তনের জোর দাবি করছি। সেই সঙ্গে উপরোক্ত সমস্যাবলি আসলে সমস্যা কি না, তা যাচাইয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি সর্বোপরি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করি।

 

লেখক : সাংবাদিক

gopalodikari1213@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads