• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
করোনা ভাইরাস ও  আমাদের সতর্কতা

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

করোনা ভাইরাস ও আমাদের সতর্কতা

  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০২০

আফরোজা পারভীন:

করোনা ভীতিতে আক্রান্ত সারা দেশ। সারা দেশ না বলে সারা পৃথিবী বলা ভালো। উন্নত পৃথিবী থেকেই এ রোগ আমাদের দেশে এসেছে। আর এ রোগ এসে প্রমাণ করে দিয়েছে ভাইরাস উন্নয়ন-অনুন্নয়নের ধার ধারে না। সে সর্বত্রগামী। যেমন যেতে পারে পর্ণকুটিরে তেমনি চোখ ধাঁধানো অট্টালিকায়। কোনো দারোয়ান, কোনো সিকিউরিটি তাকে আটকাতে পারে না। আটকাতে পারে সাবধানতা, সচেতনতা। আমরা দেখছি ধনী-গরিব নির্বিশেষে আক্রান্ত হচ্ছে এ ভাইরাসে। তবে বড় মানুষ, প্রতিষ্ঠিত মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের একাধিক মন্ত্রী আর হোমরাচোমরা আক্রান্ত হয়েছেন রোগে। আমি সর্বান্তঃকরণে আক্রান্তদের নিরাময় কামনা করি।

এ অসুখে শিশু এবং বৃদ্ধের রিস্ক নাকি বেশি। মেয়ে সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে চিন্তিত। সেদিন আমার এক আত্মীয় বাসায় বেড়াতে এলে আমি তাকে জড়িয়ে ধরাতে মেয়ে খুবই নাখোশ হয়েছে। আত্মীয়দের মধ্যে দুজন আবার সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন। কি করা যাবে। এটা বাঙালি সংস্কৃতি। আপনজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হবে আর জড়িয়ে ধরবে না, আদর করবে না— এটা হয় কখনো। তাতে আমরা পুরোনো দিনের মানুষ। মনে হয় যেন মাত্র কদিনের কথা। মা বলছেন, বুঝবে না মণি আমরা পুরোনো দিনের মানুষ। মাত্র কদিনের ব্যবধানে মায়ের সে সংলাপ উঠে এলো আমার কণ্ঠে। এর নাম বুঝি ধারাবাহিকতা, আত্মীকরণ। যা বলছিলাম আমরা পুরোনো দিনের মানুষ। আমাদের সঙ্গে এখনকার মানুষের অনেক কিছুই মেলে না। মনে আছে আমার বিয়ের সময় কাঁদতে কাঁদতে এমনভাবে আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিলাম যে, ভাইয়ের পিঠে আমার হাতের নখ বসে গিয়েছিল। এখন বিয়েতে মেয়ের কান্না দেখা মোটামুটি অসম্ভব দৃশ্য। ছেলেমেয়ে বিয়ের স্টেজে বসে দিব্বি হাসে, সেলফি তোলে, গল্পগুজব করে, এ-ওর ঘাম মুছিয়ে দেয়। আমরা দেখি আর অবাক হই। এর একটা বড় কারণ এটাই যে, অনিশ্চয়তা অনেকটাই কেটে গেছে। আগে একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা পরিবেশে মেয়ে যেত। সেখানে সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার ব্যাপার ছিল। বেশিরভাগ পরিবারই ছিল যৌথ। তা ছাড়া বাবা-মাকে ছেড়ে যাবার একটা কষ্ট তো ছিলই। এখনকার মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে। পছন্দের বিয়ে না হলেও কথাবার্তা হবার পর নিজেদের মধ্যে জানাশোনা হয়। তখন ছেলেমেয়ে অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এখনকার বেশিরভাগ মেয়ে স্বনির্ভর। তাই স্বামী বা শ্বশুরবাড়িকে সন্তুষ্ট করা নিয়ে তেমন ভাবে না। অনেকেরই টার্গেট থাকে যত দ্রুত সম্ভব একা হয়ে যাওয়া। অনেকে তো দূরে থাকেই। আর বাবা-মা! এখনকার মেয়েদের বাবা-মায়ের কাছে যেতে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ির অনুমতি লাগে না। কাজেই নিরাপত্তাবলয় জোরদার থাকলে, অনিশ্চয়তা না থাকলে কান্না না পাবারই কথা।

তারপরও কথা থাকে। ইমোশন বলে একটা জিনিস আছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওটার বড় অভাব । অবশ্য এ কথা সব মেয়ের বেলায় প্রযোজ্য না। এই আকালের রাজ্যেও কেঁদে ভাসিয়ে দেয় এমন বিরল দৃশ্য কখনো কখনো দু-একটা চোখে পড়ে। তবে চোখে পড়া ভাগ্যের ব্যাপার। একাল আর সেকালের ব্যাপারটা শুধু বিয়ের বেলায় প্রযোজ্য না। একালের ছেলেমেয়েরা যেমন স্মার্টলি সবকিছু নিতে পারে আমরা তা পারি না। এই যে বিয়ে ভাঙা, প্রেম ভাঙা এগুলো এখন খুবই সহজ ব্যাপার। ছেলেমেয়েরা স্মার্টলি বলে, মতের মিল যখন হচ্ছে না বিয়ে ভেঙে যাক। ভেঙে ফেলেও। বারবার প্রেমে পড়াকে কোনো ব্যাপারই মনে করে না আজকালের ছেলেমেয়েরা। আমরা পুরোনো দিনের মানুষ, আমরা মনে করি। ইস্টাবলিশমেন্ট ভাঙতে ভয় পাই। যাক কিসের থেকে কিসে চলে এলাম। এটাও কিন্তু ওই যে বয়সের কারণ। খেই থাকে না। শুরু করেছিলাম করোনা ভাইরাস নিয়ে। যে রোগের কোনো ওষুধ নেই সে ব্যাপারে তো সতর্ক থাকাই উচিত। সে কারণে বড় বড় সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে। এয়ারপোর্টে সতর্ক অবস্থা। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার জোর দাবি উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আসার কথা ছিল। সেটা বাতিল হয়েছে করোনার জন্য। মন্দের ভালো হয়েছে। তার আসা নিয়ে দেশে একটা অসন্তোষ ছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানে লোকজন গোমূত্র খাচ্ছে, গোবরে গড়াগড়ি যাচ্ছে।

প্রাণিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাকি মানুষ। প্রতিদিন মানুষের পায়ের তলায় পড়ে কত পিঁপড়ে, পোকা আর ছোট ছোট জীব মারা যাচ্ছে আমরা জানিও না। মশা, মাছি মারার জন্য আমরা কত পদ্ধতিই না নিচ্ছি। গরু-ছাগল জবাই করছি, খাচ্ছি। বাঘ, সিংহ বলশালী হলেও তারা থাকে প্রকৃতিতে। এটা স্রষ্টার তৈরি ভারসাম্য। কিন্তু অরণ্য নেই বলে তারাও আজ কমতে কমতে শূন্যের কাছাকাছি। মানুষের আগ্রাসনের শিকার। বনের পশুকে আমরা আটকে রাখি চিড়িয়াখানায় বা অভয়াশ্রম নামে হাস্যকর আরেক জাতীয় বন্দিশালায়। আমরা একবারও ভাবি না আমাদের বনে নিয়ে ছেড়ে দিলে বা জেলবন্দি করে রাখলে কি দশা হবে। ভাবি না কারণ আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। নিজেরা কি করে আরো পাব আরো খাব আরো উপরে উঠব— এটাই এখন আমাদের চিন্তা। আমরা আমিত্বের বাইরে যেতে পারি না। সেই আমিত্ব এতটাই প্রকট যে নিচে তাকানো তো দূরের কথা, পাশে তাকাতেও অনিচ্ছুক আমরা। কিন্তু আমরা ভুলে যাই একা একা থাকা যায় না, বাঁচা যায় না। অরণ্যে ছেড়ে দিলে আমরা বাঁচব না, নির্জন দ্বীপেও না। আর কী মজার কথা, সেই আমিত্ব সর্বস্ব আমরাই এখন বাঁচার জন্য গোমূত্র খাচ্ছি, গোবরে গড়াগড়ি যাচ্ছি। বলিহারি আমিত্ব!

করোনার কারণে চারদিকে আতঙ্ক। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাস্কের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মেয়ে করোনা এইভাবে বিস্তারিত হবার দিন কয়েক আগে বাসার চারজনের জন্য চারটে মাস্ক এনেছিল ১৬০০ টাকা দিয়ে। আমার ধারণা ছিল এক একটার দাম বড়জোর তিরিশ টাকা হবে। ৪০০ টাকা শুনে চোখ চড়কগাছ হয়েছিল। মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম। জানতাম এ মাস্ক কেউ ব্যবহার করবে না। ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে। এমন অনেক মাস্ক আমি জীবনভর পেয়েছি, কিনেছি আর গড়াগড়ি খেয়েছে। কিন্তু কদিন পর শুনলাম ওই দামি মাস্ক বাজার থেকে উধাও। আমার এক বন্ধু তার জামাইয়ের জন্য বিদেশে পাঠাতে গিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পায়নি। দশ টাকার সাধারণ মাস্কের দাম হয়েছে ২০০ টাকা। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত করছে কী! এই জীবন রক্ষাকারী জিনিসটির দাম যারা বাড়িয়েছে তাদের কেন ধরে ধরে গরাদে পুরছে না। মানুষের জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী নিয়ে এরা ব্যবসা করছে আর মানুষ অনিশ্চয়তায় ভুগছে। মাস্ক পরলেই যে সব ভয় কেটে যাবে তেমনও নয়। জানা গেছে, আক্রান্তদের জন্য মাস্ক জরুরি। কিন্তু করোনার জন্য মাস্ক জরুরি হোক বা না হোক ধুলাবালি হাঁচি, কাশি থেকে বাঁচার জন্য জরুরি এটা তো ঠিক। বারবার হাত ধোয়া, হ্যান্ডশেক না করা, হাঁচি-কাশি থেকে দূরে থাকা এগুলো খুবই জরুরি।

শেষ কথা বলি, কোনো কোনো প্রসঙ্গ তুলে অনেকে বলছে, ‘আল্লাহর মার দুনিয়ার বার।’ আল্লাহর মার যে দুনিয়ার বার একথা তো সবারই জানা। এতে বলাবলির কি আছে। কিন্তু এমন মার আমরা চাই না। চাই না এ মারে আটকা পড়ি— আপনি, আমি, অন্য মানুষ, অন্য দেশের মানুষ। কে কখন কোথায় আক্রান্ত হবেন তার তো কোনো ঠিক নেই। তাই ওসব কথাবার্তা বাদ দিয়ে প্রত্যেকেই নিজের মতো সতর্ক হোন, আশপাশের মানুষকে সতর্ক করুন।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads