• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও টেকসই কৃষি উন্নয়ন

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও টেকসই কৃষি উন্নয়ন

  • প্রকাশিত ৩০ মার্চ ২০২০

মো. বশিরুল ইসলাম

 

 

বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার সঙ্গে যে ব্যক্তির নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ বছর তার জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। যা একটি জাতির জন্য গর্বেরও বটে। আমি নিজ চোখে এই মহান নেতাকে না দেখলেও তার জ্বালাময়ী ভাষণ আমাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। তার হাসি, তার আঙুল তুলে বজ্রকণ্ঠের ভাষণ, তার ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার পরিচয় বহন করে আমার কাছে। এ দেশকে যত দেখি তার অপর পিঠে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই। এই মহান নেতার কারণে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এই স্বাধীন দেশের বয়স  মহাকালের বিচারে  ৪৯ বছর খুব বড় সময় নয়। তবে এই সময়ের ব্যবধানে কোনো কোনো জাতির অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার নজিরও আছে।

আমাদের এই স্বাধীন দেশও স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। পরিণত হচ্ছে সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে। অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ফলে আজকের বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বেশি সাফল্য কৃষি ক্ষেত্রের পরিবর্তনটি আমার দৃষ্টিতে অনেক বেশি স্পষ্ট। কারণ, আমি কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কাজ করি, কৃষকের সঙ্গে মিশি। তাদের সমস্যাগুলো নিজের সমস্যা মনে করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তুলে ধরতে চেষ্টা করি। সাফল্যগুলোকে দেশের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরি। আমার এ পথচলার বিবেচনায় এ কথা অকপটে বললে ভুল হবে না যে, বর্তমান সময়টি কৃষির সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ একটি সময়। ফলে ফসলে অভাবনীয় প্রাচুর্য দেখছি আমরা।

অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও, জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুতগতির সঙ্গে সীমিত ও সংকুচিত হয়ে আসা জমি নিয়েও মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, যা অভাবনীয়। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তার সঙ্গে বিশেষ অবদান রয়েছে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিষ্ট গবেষণায় উচ্চ ফলনশীল, কম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন জাত ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদি পশু, পোলট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি।

স্বাধীনতার পর বিগত ৪৯ বছরে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে চার গুণ। যা বিশ্বে চতুর্থ। শাকসবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় যা চীন-ভারতের পরেই রয়েছে। মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং প্রতিবছরই উদ্বৃত্ত থাকে বিপুল পরিমাণে। এ ছাড়া আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ।

ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্লাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম।  মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৮ সালে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে মাংসের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রাণিসম্পদ বিশেষত পোলট্রি শিল্প দেশে গার্মেন্টসের পরই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে বিবেচিত। কৃষিবিজ্ঞানীরা পাটের ওপর গবেষণা করে এই ফসলের জীবনরহস্য উদ্ভাবন করেন, যা এক যুগান্তকারী ঘটনা। আবার সম্প্রতি মৎস্যবিজ্ঞানীদের ইলিশের ওপর এই প্রজাতির জীবনরহস্য উদ্ভাবন আরও একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রতিবছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।

তবে এটা ঠিক, আমরা সব সময়ই দেশে ভালো ফলনের খবর রাখি কিন্তু কৃষক উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তার খরচ তুলতে পারল কি না, তার কোনো হিসাব পাই না। সরকার যতই উপকরণ সহযোগিতা দিক না কেন, তার দাম কৃষককে দিতেই হয়। সার-বীজ ডিলাররা ঠিকই তাদের উপকরণের দাম পেয়ে যায়, কিন্তু কৃষক কিছুই তার ঘরে তুলতে পারে না। সব খরচ মিটিয়ে তাকে অনেকটা খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয়।

২০১৯ সালের একটি তথ্য তুলে ধরছি। বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোরডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা এই ফসলের ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া গ্রামের আব্দুল মালেক সিকদার নামে এক কৃষক। এতে আরও বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আর একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৮৫০ টাকা। এতে প্রতি মণ ধানে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাতে আব্দুল মালেকের মতো কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সবজির ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় একদিকে ক্রেতারা বেশি দামে কিনছে, অন্যদিকে কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ঢাকায় যে সবজি কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, সেখানে কৃষক বিক্রি করছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকায়। এ ব্যাপারে কোনো সরকারই সফলতা দেখাতে পারেনি। কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়া যেন সরকারের কোনো দায়িত্ব নয়, তাদের কাজ শুধু সার-কীটনাশক-ডিজেল দেওয়া!

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে কৃষি থাকবে না। কৃষকের কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়। অথচ তারা বেশি দাম দিয়ে কৃষিসামগ্রী ক্রয় করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কৃষকদের পণ্য কম দামে ধনীরা কিনে গুদামজাত করে ফেলে। এতে কৃষক লাভবান না হয়ে অন্য কেউ হচ্ছে। যখন কৃষকের ঘরে ধান ওঠে, তখন ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করে তারা। অথচ আকালের সময় কৃষক ৩০ টাকার পরিবর্তে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় চাল কেনে। তাই কৃষক যেন পণ্যের সঠিক দাম পায়, সে বিষয় নিশ্চিত করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কৃষকের দুর্ভোগ যেন না থাকে, এটা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ চলছে অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রমাণিত যে, ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদনের মাধ্যমেই দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব এবং একই সঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাও রক্ষা পাবে। আমরা কি বাংলাদেশে সেই পথে হাঁটছি? যদিও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ সবজি ও ফল সহজলভ্য করতে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে কৃষকের বাজার চালু করা হয়েছে; যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত করছে। ক্রমান্বয়ে এই ব্যবস্থা জেলা-উপজেলা শহরে সম্প্রসারিত করা হবে। ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সহায়তা অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও কাজুবাদাম, কফি ইত্যাদি অর্থকরী ফসল চাষ ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়নে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের কৃষি এখন অনেক উন্নত। সেখানকার চাষপদ্ধতি ও ফসল উৎপাদন এবং কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা পুরোটাই সরকার বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আশানুরূপ উন্নতি হলেও ফুড ম্যানেজমেন্ট ও আধুনিক বাজারব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। যার জন্য কর্মবীর কৃষকরা প্রায়ই উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য পান না। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ যেখানে সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। বিশাল এই সেক্টরে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও উল্লেখযোগ্য নজর নেই বলে বিস্তর অভিযোগ। মাঝেমধ্যে নানামুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না। উপরন্তু দারুণভাবে অবহেলিত থাকছে এই সেক্টরটি। আমাদের দরকার কৃষকের টিকে থাকার ব্যবস্থা করা, তবেই কৃষি টিকবে, আর কৃষকও বাঁচবে।

 

লেখক :  জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

mbashirpro1986@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads