• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
এটি কি শুধুই করোনা ভাইরাস না অন্যকিছু

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

এটি কি শুধুই করোনা ভাইরাস না অন্যকিছু

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ০২ এপ্রিল ২০২০

গোটা পৃথিবীতে এখন এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। এটি কি শুধুই একটি ভাইরাস না অন্য কিছু? মরণব্যাধি এই ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশ। সেখানে অবশ্য  আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে; কিন্তু ইউরোপের দেশ ইতালিতে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে ইতালি শীর্ষে রয়েছে। ২৯ মার্চের তথ্য অনুযায়ী সেখানে একদিনে মারা গেছে ৮৮৯ জন। এর আগে দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ নিয়ে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াল। সব মিলিয়ে ২৯ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৮২৮ এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৮২২-এ। ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও করোনা তার প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে তা এখন পরস্ফুিট হচ্ছে। এ অবস্থায় জরুরিকালীন তৎপরতায় বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করছে ভারতের সব রাজ্য। বাংলাদেশে ২৯ মার্চ পর্যন্ত ৪৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে, আর মারা গেছেন ৫ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ জন।

করোনা সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন। কারণ এত জনবহুল দেশে সরকারি হাসপাতালগুলো তো গরুর খোঁয়াড়ের চেয়েও নোংরা, সেখানে প্রতিদিন আসা রোগীরাই চিকিৎসা পায় না। ভয়ানক অসুস্থ রোগী যাদের হাসপাতাল বেডে থাকার কথা, তাদের অধিকাংশকেই হয় বেসরকারি ক্লিনিকে চলে যেতে হয়, নয়তো হাসপাতালের নোংরা ফ্লোরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এতে রোগ ভালো হওয়ার চাইতে রোগীদের আরো বেশি অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই পরিস্থিতিতে কে করোনা আক্রান্ত আর কে নয়, তা নির্ধারণই বা করবে কে? আর করলেই তাদের চিকিৎসা হবে কোথায়? তাই ব্যক্তি পর্যায়ে যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যেমন— বার বার হাত-মুখ ধোয়া, জনসমাগম যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা টিস্যু দিয়ে মুখ চেপে রাখা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি অবলম্বন করে যতটা সুস্থ থাকার চেষ্টা করা যায় ততই মঙ্গল। আমাদের খেটে খাওয়া মানুষগুলো— দিনমজুর, রিকশাওয়ালার পক্ষে এতটুকু মেনে চলাও তো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে যাদের সংগতি আছে তারা তো চিকিৎসা করাতে যান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতে। নিজ খরচে। তারপরের সারিতে যারা, তারা দেশের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করান। সরকারি হাসপাতালে আছে দালাল, আছে নোংরা পরিবেশ, আছে ভাঙাচোরা আর লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা কিছু যন্ত্রপাতি যা দিয়ে জনগণের সেবা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, ডাক্তারও আছেন, তবে তাদের পেশার চেয়ে চাকরিটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা এখানে চাকরি করেন আর অফিস টাইমের পর ডাক্তারি করেন।

অন্যান্য দেশের কথা বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের কথা আলাদা। তারা যেভাবে এবং যেমন দরকার জনগণের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন ঘরের বাইরে কাউকে আসতে না দেওয়া, নিজ নিজ বাসায় প্রয়োজনীয় খাবার রেখে দেওয়া, খাবার শেষ হয়ে গেলে রাষ্ট্র থেকেই খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি। আমাদের দেশে আমরা এগুলো কল্পনায়ও আনতে পারব না। আমাদের বরং ভয় হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা সব জিনিসপত্র আটকে চরম কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার মাধ্যমে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ সৃষ্টি করেন কিনা। তখন মানুষের তো কিছুই করার থাকবে না। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা বা ব্যবস্থা তো টিভির পর্দায়ই সীমাবদ্ধ থাকে, জনগণের ধারেকাছেও যায় না। একটি নিত্যদ্রব্য পণ্য হচ্ছে পেঁয়াজ, সেই ২০ টাকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে আমাদের ২০০ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী ‘ক্যাসিনো ব্যবসার ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে এই পেঁয়াজের ব্যবসা  দ্বারা। সেখানে সরকার তো কিছুই করতে পারেনি। এটিই হচ্ছে ভয়।

আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব, আপনাদের একটু ভেবে দেখতে হবে গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে এই করোনা ভাইরাস। এটি কি শুধুই করোনা ভাইরাস? এটি আসলে আমাদের প্রতি প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমরা অহরহ প্রকৃতির সব নিয়েমের বিরুদ্ধে কাজ করি, বিরুদ্ধাচরণ করি। প্লাস্টিকের তৈরি একটি পণ্য পাঁচশ বছরের বেশি সময় নেয় প্রৃকতির সঙ্গে মিশে যেতে অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। কিন্তু আমরা প্রতিদিন আরো বেশি বেশি যেন প্লাস্টিক ব্যবহারে আনন্দ পাই। আইন করা হলেও তার ফাঁকফোকর দিয়ে, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমরা তা করতে থাকি। শিল্প-কারখানার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার মণ বর্জ্য, কোথায় ফেলব এসব বর্জ্য? আমাদের দিকেই তো তারা ফেরত আসে।

করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট প্রবল হতে পারে। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার যদি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নেয়, তবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাবেন বলে সতর্ক করেছে আইএলও। সংস্থাটি বৈশ্বিক এ দুর্দশা থেকে রক্ষায় জরুরি, বৃহৎ ও সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছে। এর পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা এবং আয় ও চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেয়ার কথাও বলেছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে আছে সামাজিক সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি কাজের পরিধির প্রসার, ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্পের শুল্ক হ্রাস। শুরুতেই বলেছি কোভিড-১৯ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যের সংখ্যা ৩০ হাজারের হাজারের বেশি। ইউরোপে পর্যটক ঢোকায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ইউরোপ ও এশিয়ার প্রধান প্রধান শেয়ারবাজারে দরপতন অব্যাহত আছে। বাজারে প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নতুন করোনা ভাইাসের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চাইলে জরুরিভিত্তিতে আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ওপর প্রকৃতির এত ক্ষোভ কেন? আমরা একটু সবল হলেই দুর্বল মানুষের প্রতি অত্যাচার শুরু করি নানা মাত্রায়। সেটি ব্যক্তি পর্যায়ে, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়েও ঘটে থাকে। আমার গায়ে একটু শক্তি হয়েছে আমার পাশে আর কাউকে বসতে দিব না, কাছে আসতে দিব না; কারণ আমার শক্তি আছে। এই শক্তির খেলা চলছে সারা পৃথিবীতে। শক্তি হলেই আর কাউকে তোয়াক্কা করি না। আমি রাজনীতি করি, আমার পার্টি শক্তিশালী, অন্য কোনো পার্ির্টকে দাঁড়াতে দেব না। আমি শক্তিশালী রাষ্ট্র, আমার যা ইচ্ছে তা-ই করব। পার্শ্ববর্তী দুর্বল রাষ্ট্রকে সবসময় ভীতির মধ্যে রাখব, চাপের মধ্যে রাখব। আমি গোটা পৃথিবীতে শক্তিশালী, আমার সমকক্ষ কাউকে হতে দেব না, আমার ধারেকাছেও কাউকে আসতে দেব না। অমি যা বলব তাই সবাইকে শুনতে হবে, করতে হবে; তা না হলে আণবিক বোমা দিয়ে, আমার সেনাবাহিনী দিয়ে, বিমানবাহিনী দিয়ে মানবসভ্যতা শেষ করে দেব। আমি যা জানি, আমি যা মানি— সবাইকে তাই করতে হবে; তা না হলে তাদের ধ্বংস করে দেব। গোটা পৃথিবীতে আমরা এই নিয়মই চালু করেছি। এই নিয়ম কি প্রকৃতির নিয়ম? অবশ্যই না। এগুলো সবই প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিয়ম। প্রকৃতি তাই অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস যা চোখেও দেখা যায় না। অথচ তার ভয়ে গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কোথায় সব আণবিক অস্ত্র, আণবিক বোমা যা দ্বারা স্বজাতিকে ধ্বংসের মহা খেলায় মত্ত মানবজাতি। অথচ আজ তারা সবাই নিজেরাই গৃহবন্দি। তবু যেন শিক্ষা নেই মানবজাতির!

 

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads