• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কোভিড-১৯

  • প্রকাশিত ০৪ এপ্রিল ২০২০

মীর আব্দুল আলীম

 

 

 

নিয়ম মানছেন না দেশে আসা ৬ লাখেরও বেশি প্রবাসী। তাই যা হবার তাই হলো। করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ; আক্রান্ত দেশের অর্থনীতিও। প্রবাসীরাই দেশে করোনা বহন করে এনেছেন এটা অনেকটাই নিশ্চিত। গণমাধ্যমে প্রবাসীদের মাধ্যমেই করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি আমরা। বিদেশ থেকে আগতদের ব্যাপারে বহু লেখালেখি আর সতর্ক করা হলেও কেউ কথা শোনেনি। প্রবাসী, প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন, এমনকি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে করোনা ভাইরাস ঠিকই ছড়াল বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে মন্ত্রী, এমপিদের করোনাবিষয়ক বক্তব্য জনমহলে বেশ সমালোচিত হচ্ছে। সতর্ক হওয়া গেলে হয়তো বাংলাদেশ করোনামুক্ত থাকতে পারত। প্রবাসীরা এসেছেন, অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারা জনসমক্ষে চলাফেরা করছেন এখনো। বিয়ে-সুন্নতে খাতনা, জন্মদিনের অনুষ্ঠান কোনোটাই বাদ দিচ্ছেন না তারা। তাই যা হবার তাই তো হয়েছে। করোনা ভাইরাস গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে এসে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রেখে, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট ছুটি দিয়ে অঘোষিত লকডাউন করা হয়েছে, যা কি না অনেক আগেই করা উচিত ছিল।

চীন, কোরিয়া, ইতালি, স্পেনের মতো করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়ালে দেশটির কি হবে? উন্নত বিশ্ব যেখানে সামাল দিতে পারছে না বাংলাদেশের সক্ষমতা এক্ষেত্রে কতটা আছে? বাংলাদেশ পুরোপুরি আক্রান্ত হলে থমকে যাবে দরিদ্র এই দেশটি। অর্থনীতির কি হবে তখন? আমাদের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে। চলমান শিল্প থমকে গেছে। বস্ত্রশিল্পের এমনিতেই বাজে অবস্থা। করোনার প্রভাবের ধাক্কা বস্ত্র শিল্প আদৌ সামাল দিতে পারবে কি না তা সন্দেহ রয়েছে। করোনা ভাইরাস আতঙ্ক কেটে যাবে একদিন। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়ায় আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ১২০০ কোটি ডলারের সুদমুক্ত ঋণ ঘোষণা দিয়েছে ইতোমধ্যে। স্বাস্থ্য উপকরণ কিনতে ৪ হাজার কোটি ডলারের জরুরি তহবিল ঘোষণাও এসেছে। লক্ষণীয় হলো, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার শূন্যে নামিয়ে এনেছে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কি হবে? এ দেশের ব্যাংকগুলো কি শূন্য হারে তাদের গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারবে? অর্থনীতির ধাক্কা সামলানো এবং তা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মানবিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। দেশের মানুষও সতর্ক ও সচেতন। তবে বিশ্বব্যাপী মন্দাকালের পরিস্থিতি ভিন্ন। নিজ সম্পদ বৃদ্ধি, উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃচ্ছ্রতাসাধন— দুঃসময়ে এসব স্মরণে রেখেই পরিকল্পনা নিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলেরই গতি ও প্রস্তুতির আবশ্যকতা বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয় চীন থেকে। ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক আমদানিকারক চীনের বিকল্প খুঁজছেন। এখন অন্য দেশেও ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে আমদানি ও রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গার্মেন্টসহ দেশের অন্তত ১৩ থেকে ১৪টি খাতে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিচারে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি কিছু পণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। একইভাবে প্রবাসী আয়ও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইতালির মতো বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পণ্যের সাপ্লাই চেন বন্ধ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণে অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারকে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে আগামী ছয় মাসের জন্য একটি অর্থনৈতিক ঝুঁকির বাজেট করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পরামর্শগুলো সরকার বিবেচনা করে দেখবে বলে আশা করা যায়। সরকারও বসে নেই। সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করছে। আপাতত মানবসম্পদের সুরক্ষা বা মানুষের জীবন বাঁচানোই প্রথম বিবেচনা হলেও অর্থনীতির সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঠেকাতে বাস্তবমুখী পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনার স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়তো সাময়িক। দুঃসময় কেটে যাবে একদিন। কিন্তু অর্থনৈতিক বিপন্নতা বা ক্ষতি প্রলম্বিত হয়ে থাকে।

আমরা কিন্তু এ মহামারী থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতাম। আমরা সচেতন ছিলাম না কেউই।  দেশের জনগণ, প্রশাসন, সরকার সবাই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যাদের করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কেউই বিদেশি নয়, প্রবাসী বাংলাদেশি। অর্থাৎ আক্রান্ত অন্য দেশ থেকে তারা করোনার জীবাণু সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত (৩০ মার্চ) ৪৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ১৯ জন সুস্থ হয়েছেন এবং ৫ জন মারা গেছেন। কিন্তু শুরুতে এই আক্রান্ত ছিল মূলত বিদেশ ফেরতদের সংস্পর্শে আসার দরুণ। এটি খুবই দুঃখজনক।

এ কথা সত্য যে, আমরা এক ভয়ংকর সময় অতিক্রম করছি। আমরা বলতে গোটা বিশ্ববাসীই। এ সময় সাহস, সচেতনতা, সতর্কতাই সবচেয়ে আগে দরকার। রোগ প্রতিরোধে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করা চাই। এ সময় যিনি আতঙ্ক ছড়াবেন তিনি সঠিক কাজ যে করবেন না সেটি বলাই বাহুল্য। তাই আতঙ্ক না ছড়িয়ে মানুষের মাঝে মনোবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিন। নিজে সচেতন হতে হবে, পরিবার, প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে। সাহস দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিন জনগণকে সাহস জোগাচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে খোঁজখবর নিচ্ছেন। দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্যানিক (আতঙ্ক) করবেন না, শক্ত থাকেন, সচেতন হোন।’ প্রকৃতই সচেতন না হওয়ার বিকল্প নেই। ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে মিলেমিশে সতর্কতার সাথে এ বিপদকালীন সময় পার করতে হবে। কারো মধ্যে সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে। রোগ হলে রোগ লুকিয়ে রাখার মতো বোকামি করা চলবে না। পরিবার তথা সমাজের অন্যকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এই সচেতনতাটুকু সবার মধ্যে থাকা চাই।

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ান। অন্যকে সহযোগিতা করা ও সচেতন করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কেউ স্বেচ্ছায় করোনা ভাইরাস বিষয়ে সচেতন না হলে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। প্রশাসন ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা যাতে সমাজে আতঙ্ক না ছড়ায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads