• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস : একটি গ্রামের বাস্তবচিত্র

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস : একটি গ্রামের বাস্তবচিত্র

  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২০

ফরহাদ আলী

 

 

 

১৮ মার্চ ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করায় সেদিনই বাড়ি চলে আসি। গ্রামে এসে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করলাম, এখানে করোনা নিয়ে আতঙ্ক এবং তাচ্ছিল্য পাশাপাশি অবস্থান করছে। এর সাথে যোগ হয়েছে শক্তিশালী গুজবে বিশ্বাস, আছে ধর্মান্ধতার নির্যাস এবং চায়ের দোকানে করোনার রাজনীতিকীকরণ করার জোর প্রয়াস। বিষয়টি কেউ নিচ্ছেন একেবারে হেঁয়ালিরূপে, কেউ নিচ্ছেন অমুসলিম দেশগুলোর মুসলমানদের ওপর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। আবার অতি উৎসাহী কেউ কেউ তো এটাকে সরকারের একটি রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন। যখন তাদের কাছে সচেতন থাকার কথা বলা হয়, তখন তারা প্রবলভাবে ধর্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। আদতে এদের বেশিরভাগই শুক্রবারের নামাজও পড়তে মসজিদে যান না।

এবার একজন মহিলার কথা বলি। এই মহিলার তথ্যটি ছিল আগেরটির থেকে চমকপ্রদ! সে নাকি খবর পেয়েছে যারই করোনা হচ্ছে তাকেই নাকি সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে খুঁজে বের করে গুলি করে মারছে। এই কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এই মহিলাকে কোনো যুক্তিও দেখালাম না। শুধু বললাম যা শুনছেন তা সত্য নয়। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে দাদি এসে দিল আরেক রকম সংবাদ। করোনা ভাইরাস নাকি শুধু ইহুদি আর খ্রিস্টানদের জন্য বরাদ্দ আল্লাহর গজব। এটা নাকি মুসলমানদের স্পর্শও করবে না। কোনো বড় মাওলানা হুজুর নাকি তাই বলেছেন। এ সংবাদ শুনে মনে মনে বড্ড হাসিও পেল। ভাবলাম করোনা তো দেখি ভীষণ সাম্প্রদায়িক ভাইরাস। দাদিকে মক্কা-মদিনায় ভাইরাস সংক্রমণের খবর দিতেই ইন্নালিল্লাহ পড়তে পড়তে ভেতরে চলে গেলেন। আর কিছু বলতে হলো না।

সন্ধ্যার আগে গ্রামে বের হয়ে একটু হাঁটতে ছিলাম। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে তেমন উত্তেজনা দেখলাম না। বাজারের দিকে রওনা হলাম। সেখানে দেখি অনেক মানুষ এক জায়গায় বিড়ির ধোঁয়ায় আশপাশটা কুয়াশাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এদের মধ্য থেকে আবার কয়েকজন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে নিজেদের মতো করে বিশেষজ্ঞসুলভ বর্ণনা করছে। যার প্রায় ৯০ ভাগ তথ্য ভুল এবং অতিরিক্ত রং চড়ানো। আমাকে দেখে একজন ডাক দিল। কাছে যেতেই ঢাকার খবর জানতে চাইল। বাকিরা চুপ হয়ে আমার দিকে মনোযোগ দিল। যতটুকু জানা তা বললাম, সাথে বৈশ্বিক পরিস্থিতিও কিছুটা বললাম। শেষে সতর্ক থাকতে আর জনসমাগম এড়িয়ে চলার  কথা বলতেই প্রায় সবাই কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাল। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল যে, আল্লাহ না মারলে ভাইরাসের কোনো ক্ষমতা নেই। মরণ কপালে থাকলে ঘরে বসে থাকলেও মরবে, একথাও যোগ করল কেউ। আল্লাহ চাইলে কিচ্ছু করা লাগবে না বলে গর্বে বুক ফুলিয়ে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল প্রকাশ করল অভাবের সময় চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে ‘আপনিই আমার একমাত্র সহায়’ বলা একজন। তাদের কথার সাথে সঙ্গতি প্রকাশ করেই বললাম তারপরও তো সতর্ক থাকতে হবে। শেষে বললাম কেউ তো কখনো চিতাবাঘের সামনে যাবে না, শুধু আল্লাহ রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস নিয়ে। তাহলে আমরা ভাইরাসের বেলাই শুধু এমনটা ভাবি কেন? কেউ কেউ হয়তো আমার কথাটা ধরতে পারল, কিন্তু অধিকাংশই তাদের গোঁ বজায় রাখলেন। কেউ কেউ তো আমার তাওয়াক্কুলের দুর্বলতা দেখে ভীষণ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন। একসময় মাদরাসার ছাত্র ছিলাম; কিন্তু এখন আমার এই ধরনের কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো কি না জানি না, তবে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি  করতে লাগলেন।

এর মধ্যে কয়েকদিন কেটে গেল। সরকারি নির্দেশনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার শাস্তি ছয় মাস স্থগিতও করা হলো। কয়েকদিন আগে করোনার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সেই ব্যক্তিই আবার নতুন করে মানুষের মাঝে বলে বেড়াতে লাগল যে, খালেদা জিয়া যাতে সহজে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, সে জন্য সরকার তাকে জেল থেকে বের করে দিচ্ছে। অন্যদিকে কালোজিরা, আদাজল খেয়ে করোনা মুক্তির ব্যাপারটা না হয় আর নাই বললাম। একটা সংকটময় মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মাঝে এই যে বিভ্রান্তি বা গুজবের উত্থান, এ জন্য কিন্তু এই সাধারণ মানুষের খুব বেশি অপরাধ নেই। এই মানুষগুলো খুব সহজ-সরল এবং বিশ্বাসপ্রবণ। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই নিরক্ষর বলে এরা অতটা যাচাই-বাছাই করারও প্রয়োজন মনে করে না। দু-একজন সচেতন মানুষ এর প্রতিবাদ করলেও এদের কাছে পাত্তা পায় না। তাই তারাও এখন আর কিছু বলে না। এই সহজ-সরল মানুষগুলোর সরলতারই সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির সচেতন অথচ স্বার্থান্বেষী মানুষ; যারা নিজেদের ব্যক্তিগত অথবা দলীয় স্বার্থের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে বা পরিস্থিতির বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছে, যাতে করে জনগণকে পরিস্থিতির বিপক্ষে খেপিয়ে তোলা যায়। এর ফলে সমাজে এমন এক উদ্ভট ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, যাতে করে সচেতন এবং অসচেতন সাধারণ মানুষ একসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সংকট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যতটুকু এগিয়ে যাওয়ার কথা, ততটুকু এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই চরিত্রহীন মানুষগুলোর মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় অনেক বড় রকমের জখম হয়েছে যে, নিজের স্বার্থে পৃথিবীর ধ্বংসে রাজি হতে বললেও এই শ্রেণির মানুষ তাও করতে পারবে। যেদিন আমাদের এই মানুষগুলোর বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয় বরং ভুলের সমালোচনা এবং সঠিকের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ভেতর থেকে সুষ্টি হবে, সেদিন আমাদের বাঙালি সমাজও পথ খুঁজে পাবে। আমরাও সেই দিনেরই অপেক্ষায়।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads