• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
জীবনে আলো আসবেই

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

করোনা কথা

জীবনে আলো আসবেই

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে গত বছরের শেষদিকে প্রথম দেখা দেয় করোনা ভাইরাস। প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণ উহানে সীমাবদ্ধ থাকলেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। ইতোমধ্যে কেড়ে নিয়েছে প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণ। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশ্ব আজ হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামলাতে। জারি রয়েছে বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা। থমকে গেছে সব কর্মকাণ্ড। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ এখন পুরোপুরি বন্ধ না হলেও সীমিত পর্যায়ে সতর্কতার সঙ্গে চলছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা। থমকে গেছে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যও। সেই স্থবিরতা আমাদের দেশেও। মানুষের জীবন বাঁচাতে দেশে দেশে লকডাউন, কারফিউয়ের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বিশ্বকে। আমাদের দেশেও করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রথমদিকে সরকারকে ছুটি ঘোষণা করতে হয়। প্রথম দফা ছুটি শেষে তা আবার বাড়ানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষ সুস্থ থাকুক, নিরাপদ থাকুক। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল দেশের মানুষ। তারা নানা অজুহাতে বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বারবার প্রচার হচ্ছে গণমাধ্যমে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও তাদের গাড়ি থেকে হ্যান্ডমাইকে বার বার প্রচার করেছে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যেতে। কিন্তু তা যে সম্পূর্ণভাবে মানা সম্ভব হয়েছে এমন নয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কঠোর হওয়ার কথাও বলেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই, কোনো ভীতিই যেন আমাদের ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। যারা হতদরিদ্র, যারা দিন এনে দিন খান, তাদের তো খাবার জোগাড় করতে বেরুতেই হয়; কিন্তু যাদের সেই সমস্যা নেই, তারাও নানা অজুহাতে বেরিয়ে পড়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলোতে তাদের বাইরে বেরিয়ে পড়া, গলির মুখে, চায়ের দোকানের আড্ডায় তাদের মেতে ওঠার দৃশ্য হরহামেশাই তুলে ধরা হয়েছে। অথচ খোশ গল্পের সময় এটি ছিল না। সারা বিশ্ব আজ কাঁদছে। প্রতিদিন যেভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক এই মহামারী আজ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে পৃথিবীকে। ইউরোপ, আমরিকাও লন্ডভন্ড। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন, কারফিউয়ের পাশাপাশি নানা কর্মসূচি নিতে বাধ্য হয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশ। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষ যেন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে। কারণ প্রতিষেধক অজানা এই রোগের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র হাতিয়ার আলাদা হয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। ভাইরাস, এই শব্দটির মাঝেই রয়েছে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার তরিকা। ভি, আই, আর, ইউ, এস— এই ইংরেজি বর্ণগুলো মিলে হয় ভাইরাস। এ থেকে যদি শুধু আই এবং ইউ-কে আলাদা করে ফেলা হয়, সেটাই আপাতত করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার তরিকা। প্রতিষেধক না থাকা ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যত বেশি পরীক্ষা করা হবে তত কমে আসবে এই রোগের প্রকোপ। কারণ পরীক্ষা করে কারো শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি মিললেই তাকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব, যাতে করে তার থেকে অন্য কারো শরীরে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না। এজন্যই জোর দেয়া হচ্ছে ব্যক্তিসচেতনতাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা এবং নিজেকে অন্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একেই এখন করোনা মোকাবিলার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরে থাকার এই নীতিকে কাজে লাগিয়েই কোনো কোনো দেশ আটকেও দিয়েছে করোনার অপ্রতিরোধ্য গতি। বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করেছে এই নীতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে গতিতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছিল, আশার কথা আমরা সেই ঝড় থেকে এখন মুক্ত। শুরু থেকেই করোনা রোগী শনাক্ত হওয়া এবং করোনায় মৃত্যুর ঘটনার ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকার মতো ভয়াবহ ছিল না আমাদের অবস্থা। আর এ কারণেই আমাদেরকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমান সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশ থেকে যারা ইতোপূর্বে ধাপে ধাপে দেশে এসেছেন কিংবা এখনো আসছেন; এই সময়ে তাদের অধিকাংশের কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষ হবে। দেশের ভেতরেও যারা তাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদেরও কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ একসময় শেষ হয়ে যাবে। আর সে জন্যই নতুন করে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা যেন না বাড়ে, তার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতা অবলম্বন করে চলা এবং যতটা সম্ভব ঘরে থাকা জরুরি। এতে করে ব্যক্তি আমি যেমন, তেমনি আমার পরিবারের সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে। মানুষ এ অবস্থায় আমরা যত বেশি ঘরে থাকতে পারব, যত বেশি অন্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব ততই মঙ্গল।

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা হয়তো খুব শিগগিরই এই সংকট কাটিয়ে উঠব। কিন্তু তার আগেই, আমাদের অসচেতনতায় যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি আমাদের প্রিয়জনকে। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় এনে সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানেও কাঁটছাঁট করেছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়। আমাদের স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের স্মরণে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভব হয়নি। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে জড়িত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানও সরকার স্থগিত করতে বাধ্য হয়। মূলত এর সবই করা হয়েছে মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইছে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। সরকার চাইছে আমরা সুস্থ থাকি, নিরাপদ থাকি। সরকারের এই আন্তরিকতায় আমাদেরও সাড়া দেয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশ থেকে এসে, উন্নত দেশের শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ না করে আমাদের প্রবাসী স্বজনদের অনেকে যে ভুল করেছেন, আমরা যেন তার পুনরাবৃত্তি না করি। ঘরে থাকার সুবিধার্থে সরকার যে ছুটি দিয়েছিল, আমরা অনেকেই তা যথাযথভাবে মেনে চলার বিপরীতে একে বিনোদন ছুটি বানিয়ে ফেলেছি, সপরিবারে ভ্রমণে বেরিয়েছি। ফলে বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যুও বেড়ে যায় এবং এখন তা দীর্ঘমেয়াদি হতে চলেছে।

আমরা যদি সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতা মেনে চলি, যতটা সম্ভব ঘরে থাকতে চেষ্টা করি, নিজেকে সুস্থ রাখি, তাহলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আমরা সমর্থ হব। তাহলেই আবার আমরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাব। আজ বিভিন্নভাবে আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি, সেই ক্ষতির ভাগীদারও তো সবাই। কারণ প্রত্যেকের মাধ্যমেই সচল থাকে অর্থনীতি। যদি আমরা সুস্থ থাকি, তাহলে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে আজকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু এজন্য আগে চাই সুস্থতা। আগে চাই সচেতনতা। আশার কথা, ইতোমধ্যে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত প্রতিষেধক বাজারে আসার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। রাশিয়াও তার করোনা প্রতিষেধক জনসমক্ষে আনতে সচেষ্ট। অন্যদিকে চীনের প্রতিষেধকটি বাংলাদেশে ট্রায়ালের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুতরাং বিশ্ববাসী অতি সাম্প্রতিক সময়ে করোনা প্রতিরোধের সুচিকিৎসা পাবে বলে ধারণা করছি।

ধৈর্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সুদিন আসবেই। দুঃসময় কেটে যাবে। জীবনে আলো আসবেই। সেই আলোকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে মেখে নিতে হলে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে হবে। যা শুধু নিরাপদে ঘরে অবস্থান করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। আমরা যেন ভুলে না যাই, জীবনের চেয়ে দামি কিছু নেই।

 

লেখক : সাংবাদিক, কবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads