• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মুসলিম বিশ্বের পরস্পর বিরোধিতার অবসান কোথায়

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

মুসলিম বিশ্বের পরস্পর বিরোধিতার অবসান কোথায়

  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

আলম বাদশা

 

ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা) বলেন, ‘যার বন্ধু নেই সে-ই গরিব। আবার স্বার্থের বন্ধুত্ব সামান্য আঘাতে ভেঙে যায়।’ আমরা মধ্যপ্রাচ্যে দুটি প্রধান জোট দেখতে পাচ্ছি। এর একটির নেতৃত্বে আছে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশ এবং অন্যটির নেতৃত্বে ইরান ও তার মিত্র দেশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শত্রুতা তৈরির এই কাজ অতি সূক্ষ্মভাবে আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল করে যাচ্ছে। এই শত্রুতা যতই টেকসই হবে, আমেরিকা ও ইসরাইলের ততই লাভ। কেননা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার অস্ত্রের বাজার টিকিয়ে রাখতে চায় এবং তার আরব মিত্রদের কাছ থেকে পানির দামে তেল কিনতে চায়। বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রের শাসকরা তাদের মসনদ টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। অপরদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইল গোটা বিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে এবং মুসলিম দেশগুলোকে সংঘাতে জিইয়ে রেখে ফিলিস্তিনে তার ভূমি দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এতে আমেরিকা ও ইসরাইল তাদের ষোলোআনা স্বার্থ হাসিল করেছে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ইসরাইলকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। তৎকালীন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রায় ৫৫ ভাগ ইসরাইলকে দেয়া হয় এবং ফিলিস্তিনকে ৪৫ ভাগ ভূমি দেয়া হয়। ফলে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে পরাধীন হয়ে যায়। এরপর থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে আসছে। আস্তে আস্তে মুসলিম দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থের কারণে ফিলিস্তিনের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে এবং দুর্বল হয়ে যায়। আমেরিকার ভয়ে অন্যান্য মুসলিম দেশ তটস্থ থাকে। কিন্তু ইরান ইসরাইলের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করার কারণে আমেরিকা তার ওপর অন্যায় অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়।

অন্যদিকে আমেরিকা বিশ্বমঞ্চে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রচারক হিসেবে জাহির করলেও সৌদি জোটের মাঝে গণতন্ত্র প্রচার করতে নারাজ। কেননা তখন তার প্রকৃত স্বার্থ হাসিল হবে না। বাস্তবতার এই খেলায় আমেরিকা বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। সম্প্রতি সৌদি জোটের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে অনেক আগেই মিশর, জর্ডান, সুদান, বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এর পরেও ২০০২ সালের ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ যতটুকু আশা দেখিয়েছিল, তাতেও ইসরাইল-আমিরাতের চুক্তি নিভিয়ে দিয়েছে।

মোটাদাগে মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক স্বার্থের কারণে হাজার হাজার নিরীহ ইয়েমেনীয়, ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ার মানুষ তাদের জীবন হারাচ্ছে, যেখানে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সমর্থিত সরকারি বাহিনী ও ইরান সমর্থিত হুথিদের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে। ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি জোট নিজেদের স্বার্থের কারণে মুসলিম বিশ্বের মারাত্মক ক্ষতি করছে। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র সংগঠন ওআইসি এখানে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা এখানেও মুসলিম দেশগুলোর মাঝে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে। সৌদি আরব সবসময় ওআইসি-তে প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। এ কারণে ওআইসি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কেননা ওআইসি-তে ইরান ও তুরস্ক প্রাধান্য বিস্তার করুক তা সৌদি আরব চায় না।  সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরবের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না, যা পাকিস্তানের কাম্য নয়। উল্টো সৌদি আরব ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাচ্ছে।

অন্যদিকে ইরান চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে। কেননা আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে তার অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু উইঘুর মুসলিমদের প্রশ্নে ইরানের নিষ্ক্রিয়তা দুঃখজনক। কথায় আছে, বন্ধুর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না, তাতে বন্ধু হারিয়ে যাবে। ইরান হয়তোবা সেই নীতিতে চলছে।

মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ এবং ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের এই দুর্দশার সময় এগিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা তার বাস্তব প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি লিবিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন বিষয়ে তার সরব উপস্থিতি। তুরস্ক নতুন উদ্যমে তার হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। বলে রাখা দরকার, ২০২৩ সালে তুরস্কের ওপর চাপিয়ে    দেয়া লুজান চুক্তির সময় শেষ হতে চলেছে। এ  চুক্তির শর্ত ছিল যে, তুরস্ক তার অভ্যন্তরে অবস্থিত বসফরাস প্রণালি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে না, ধর্মনিরপেক্ষতা হবে দেশটির আদর্শ। এসব শর্তের বেড়াজালে তুরস্ক অনেক কিছুই করতে পারেনি। তবে ইতোমধ্যে ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। তুরস্ক কৌশলগত কারণে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টা করছে। এ কারণে তুরস্ক আমেরিকা ও ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইল তুরস্ককে সৌদি জোটের সঙ্গে শত্রুতা তৈরিতে ব্যর্থ হবে। কেননা মতাদর্শগত দিক দিয়ে তুরস্ক সুন্নি ধারার এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র।

যা হোক, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও কাতার মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের চেষ্টা করছে, যা মুসলিম বিশ্বের জন্য ইতিবাচক। অবশেষে আলোচনার প্রথমে উল্লেখিত বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তির দিকে নজর দেয়া যাক। তিনি বলেছিলেন, ‘যার বন্ধু নেই সে-ই গরিব। আবার স্বার্থের বন্ধুত্ব সামান্য আঘাতেই ভেঙে যায়।’ প্রসঙ্গত আমেরিকা, ইসরাইল ও সৌদি জোটের সম্পর্ক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে রচিত। যার ক্ষয় আবশ্যক। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় জোটটি হয়তো সফল হবে। আর সেটা যদি হয়, তাহলে মুসলিম বিশ্বের চরম দুর্দশার অবসান হতেও পারে। সময়ের স্রোত ও ঘটনার বাহুল্যতা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার পালা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads