• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতে নজর দেওয়া জরুরি

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতে নজর দেওয়া জরুরি

  • প্রকাশিত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

মো. ফুয়াদ হাসান

 

ব্যাংক বলতে সাধারণত এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যা আমজনতার কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই মূলধন বা পুঁজি উদ্যোক্তা বা ব্যক্তিদের ঋণ দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলায় বহুল প্রচলিত ব্যাংক (Bank) একটি ইংরেজি প্রতিশব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ক্ষেতের আইল, নদী বা জলাশয়ের তীর, লম্বা টুল বা বেঞ্চ, কোনো কিছুর স্তূপ, ধনভান্ডার ইত্যাদি। অধিকাংশ মনীষীর মতে, Banco শব্দ থেকে ইংরেজি ব্যাংক শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ লম্বা টুল বা বেঞ্চ। এতে বসে ব্যবসায়ীরা অর্থের ব্যবসা করতেন। তখন এ ব্যবসায়কে Banco বা Bancus বলা হতো। পরবর্তীকালে ইংরেজিতে Bank শব্দটি অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ীদের বোঝাতেই ব্যবহূত হয়ে আসছে। আধুনিককালে ব্যাংক শব্দ দ্বারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যার কাজ হলো অর্থ জমা রাখা, ঋণ দেওয়া ও অর্থসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে জড়িত থেকে ব্যবসা পরিচালনা করা।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় : তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক। ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪২টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশে মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি এবং অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৫টি। আমাদের অর্থনীতিতে এই বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণ দৃষ্টিতে আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদানই ব্যাংকের প্রধান কাজ হিসেবে ধরা হয়। বাস্তবে ব্যাংকের কার্যপ্রণালী ব্যাপক। দেশের অর্থনীতির সব কয়টি খাতে ব্যাংকের রয়েছে সরব পথচলা। কৃষি, বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যমী তরুণদের স্বপ্ন পূরণে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে ব্যাংক খাত। ব্যাংক ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক ও সচল রাখে। বাংলাদেশের এই বিপুলসংখ্যক ব্যাংক যে শুধু আর্থিক লেনদেনের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই তার বড় উদাহরণ বেকার সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখা। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক খাতে নিয়োজিত রয়েছে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি। এতে একদিকে দেশের অর্থনীতি সচল থাকছে অন্যদিকে হাজার হাজার কর্মক্ষম যোগ্য বেকারের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

গত বছরের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটা ছন্নছড়া হয়ে গেছে। জিডিপি, বাণিজ্য, বেকারত্বের হার বৃদ্ধিসহ সব সূচকে লেগেছে ধস, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে হামাগুড়ি দিতে অনেকটা বাধ্য করেছে। এর প্রভাব থেকে বাঁচতে পারেনি দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অভাবনীয় সাফল্যের ফলে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। করোনার কারণে সেই অর্জনের ঝুড়িতে যে কিছুটা ভাটা পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনার বিরূপ প্রভাবে আমাদের অর্থনীতির ধাবমান গতিতে অনেকটা ছেদ পড়েছে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি, মাঝারি শিল্পে লোকসান, আত্মকর্মসংস্থানে ফাটল, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দেশে ফিরে আসাসহ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন আমাদের অর্থনীতি। করোনায় আমাদের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এর প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে এবং শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া কর্মহীন মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সুধীজনরা গ্রামীণ কৃষি খাতের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও পরে বন্যা আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের, বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙেছে। বন বিভাগের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্তত ২ কোটি ১৫ লাখ টাকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আম্ফানে সারা দেশে বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আম্ফানে সারা দেশে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, এবার বন্যায় ৩৭টি জেলায় সর্বমোট ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৫১ জন। এই ব্যাপক ক্ষতি দেশের অর্থনীতির জন্য সত্যিই অশুভ বার্তা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আমাদের আশান্বিত কৃষি খাতে ব্যাপক হতাশার ছাপ পড়েছে। দেশের বাজার ব্যবস্থা ও দুর্যোগ-পরবর্তী অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে সুষম কৃষি উৎপাদনের বিকল্প নেই। কিন্তু অপ্রিয় সত্য, এটাই বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব কৃষকদের দু’বেলা অন্ন জোগানো যেখানে বড় চ্যালেঞ্জ সেখানে। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ যথার্থই বলেছেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প পুঁজিই বড় সমস্যা।’ কৃষকরা স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী বা মহাজনের কাছ থেকে খুব সহজেই পুঁজি বা ঋণ পেতে পারে কিন্তু এতে হিতে বিপরীতই হবে। তাই করোনা বা দুর্যোগ-পরবর্তী কৃষি খাতের উন্নয়নে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক খাতকেও। দ্রুত, সহজ ও স্বল্প সুদে কৃষকদের ঋণ প্রদান অপরিহার্য,  যাতে কৃষকরা সহজে ও উৎসাহের সঙ্গে উৎপাদন করতে পারে। ব্যাপক হারে কৃষির উৎপাদনই পারে আমাদের অর্থনীতির ধাবমান গতিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আমাদের ব্যাংক খাত কতটা প্রস্তুত এই সংকট মোকাবিলার জন্য? করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত নয় আমাদের ব্যাংক খাতও। এমনি খেলাপি ঋণসহ নানা সমস্যায় জর্জিত আমাদের ব্যাংকগুলো। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ছাড়ের পরও ১১ ব্যাংকের প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি মেনে প্রভিশনের আকার সময়ে সময়ে নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মান অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং কু বা আদায় অযোগ্য ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

তথ্যমতে, গত জুন মাস পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে ১১ ব্যাংকের ঘাটতি। অবশিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বাদ দিলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় চার হাজার ৪৯৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ হয় ৩ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ৮৯৩ কোটি, অগ্রণীর ৮৮৬ কোটি ও রূপালী ব্যাংকের ৯২০ কোটি টাকা। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের ১ হাজার ২১৫ কোটি, কমার্স ব্যাংকের ৫৬৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৬৯৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ২০৩ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্টের ২৪৪ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৯৮ কোটি ও ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪১ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি।

এদিকে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এ হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। উক্ত সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা।

উপরোক্ত তথ্য ও উপাত্ত এটাই প্রমাণ করে করোনায় ভালো নেই আমাদের ব্যাংকগুলো। অপরদিকে মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট অর্থনৈতিক এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাংক খাতকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতেই হবে। কৃষি, পুনর্বাসন, বেকার সমস্যা সমাধান,  ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ঋণ প্রদান, আন্তর্জাতিক লেনদেনসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতই পারে সুষম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে। এমতাবস্থায় সুস্থ অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংক খাতের প্রতি আলাদা নজর দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

 

লেখক : অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads