• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মহান শিক্ষা দিবস এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

মহান শিক্ষা দিবস এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস পালন করা হয়। শিক্ষা যতটা মহান, একজন শিক্ষার্থীকে ততটাই মহান করার উদ্দেশ্য নিয়ে তা ধাবিত হওয়া উচিত। ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই মাসের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে প্রধান করে শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে ২৪ অধ্যায়ে বিভক্ত বিশাল শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। রিপোর্টের অধিকাংশ সুপারিশ গ্রহণ করে সামরিক সরকার তা বাস্তবায়ন শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সৃষ্টি হয় একের পর এক ইতিহাস। ছাত্র সংগঠনগুলো এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল স্কুল, ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং উচ্চ মাধ্যমিক ইংরেজির অতিরিক্ত বোঝা বাতিল করার বিষয়টি। এই দাবির সমর্থনে দেশের প্রায় অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্লাস বর্জন করতে থাকে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের ছাত্রসমাবেশ থেকে শিক্ষানীতি বাতিল, হত্যার বিচারসহ ছাত্রসমাজের উত্থাপিত দাবি মানার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সর্বজনীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিটি সরকারের আমলেই তা হয়েছে উপেক্ষিত। শিক্ষা এখন অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য। বাজার দরে লাভক্ষতি হিসাব করা হয়। কোন বিভাগে পড়ালেখা করলে কত দামি চাকরি পাওয়া যায় আর সেখানে কী পরিমাণ বেতন, সেসব দিয়েই মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষা এখন এটাই। কতজন প্রকৃত মানুষ হলো এসব দেখে আর কী হবে! বিদ্যা ও বিদ্বান টাকায় বিক্রি হয়। শিক্ষা তার, টাকা আছে যার। টাকা নেই, শিক্ষা পাওয়া যাবে না।

ঠিক একইভাবে, দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে বই পড়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। সারাদিন মুখ বুজে মোবাইলের স্ক্রিনে ফেসবুক ঘাঁটতে যে আনন্দ, জ্ঞানলাভে আর ততটা আনন্দ পায় না। তাই তো নতুন বই পেলে যে এক ধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয় তা ঠিক আছে, কিন্তু কয়েক মাস যেতেই সেই মুগ্ধতা আর থাকছে না। মূল বই থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঝুঁকছে গাইড বই, লেকচার শিট, প্রাইভেট এসবের প্রতি। এ সবকিছুই অবশ্য পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য। পাস করা, ভালো ফলাফল করা— এসবই যেন প্রধান উদ্দেশ্য! অবশ্য আজকালকার সচেতন অভিভাবকমাত্রই সন্তানের ভালো ফল আশা করে। আমিও করি। কিন্তু ভালো ফল করতে গিয়ে যদি পাঠ্যবইয়ের বদলে গাইড বা প্রাইভেট বা লেকচার শিটের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তাহলে সেটা একদম ভালো কথা নয়। তারপর আবার এসবের বাইরে গিয়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতার ভেতরে যে জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভান্ডার আছে, তার খোঁজ এরা করছে না। তার কারণও কি শুধুই পরীক্ষায় ভালো ফল? ফলে জ্ঞান হয়ে পড়ছে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান মেলে কি? শুধু পাস করা বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে (প্রাইভেট বা কোচিংয়ে বেশ সময়) ভালো ফল করা যায় বৈকি। তবে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় কি? মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মুক্ত জ্ঞানের চর্চা থাকা আবশ্যক।

যখন দেখি, বইয়ের বদলে ক্লাসের বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে, মোবাইল বা ট্যাবে গেমস খেলে বা অপ্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইটে ঢুকে সময় কাটাচ্ছে, তাতে মর্মাহত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ এতে তাৎক্ষণিক মনের আনন্দ মিটছে বৈকি কিন্তু মাথার ভেতর থেকে বই পড়ার ধৈর্যটা কমে যায়। বিষয়টি এমন যে একজন ছাত্র যখন তার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে যে তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে  থাকে, সেই আগ্রহ যদি বইয়ের পৃষ্ঠার প্রতি থাকত তাহলে কত ভালোই না লাগত। এখানে জড়িত আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। আমাদের মোবাইলের দরকার আছে কিন্তু মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ুয়া একজনের দিনের কয়েক ঘণ্টা মোবাইলের সঙ্গে কাটানো কতটা প্রয়োজন আছে তা বোধগম্য নয়। এর অর্থ আমি প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানবসভ্যতা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবাই এখন বড় হওয়ার জন্যই ছুটছে। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইত্যাদি কত শত লক্ষ নিয়ে ছুটছে। অনেকেই তাদের স্বপ্নের পেশায় নিয়োজিত হবে। কিন্তু এদের চাকরির বাজারে, টাকা অর্জনের বাজারে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হওয়ার গুণাবলিও অর্জন করা একান্ত জরুরি। পাসের ফলাফল দিয়ে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা যায় বটে, কিন্তু সে মানুষ হওয়ার পথে কতটুকু এগুলো তা যাচাই করতে হলে তার সার্বিক গুণাবলির দিকে তাকাতে হবে। সেটা কেবল সেই ব্যক্তি আর তার সঙ্গে জড়িত আপনজনরাই ভালো বলতে পারবে। করোনা মহামারীর কারণে এখনো এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের ওপর একটা বিরাট চাপ সম্প্রতি শেষ হলো। নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সবাই এ সুযোগ পাবে না। যোগ্যতা অনুসারে পাবে, এটাই স্বাভাবিক। জীবনে এর চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তুমি নিজেকে সত্যিকার অর্থে বড় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছ কি না। কারণ এখন এই সমাজে এসব মানুষেরই সব থেকে বেশি দরকার। সার্টিফিকেটধারী অনেক আছে কিন্তু প্রকৃত মানুষ কজন? আজ যে সমাজে এত হানাহানি, উগ্রতা এসব তো ভালো মানুষ হতে না পারারই ফল। একজন মানুষের উচ্চশিক্ষা লাভ করার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা নেওয়াটাও জরুরি। উচ্চশিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটে উচ্চ হলেই হবে না, মন ও মননশীলতায় উঁচু হতে হবে। সেই মানসিকতা গড়তে শুধু নামিদামি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এর অনেক উদাহরণ পেয়েছি। দেশে অনেক কলেজ রয়েছে, যেখানে ভর্তি হয়ে অনায়াসে উচ্চশিক্ষা শেষ করা যায়। তাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও চলবে না। সার্টিফিকেট বিদ্যা অর্জন করার পাশাপাশি আমরা যে কিছু ভালো মানুষ চাই, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

মহান শিক্ষা দিবসের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে, আজো আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। শিক্ষায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উদ্দেশ্যের দুর্বলতা আমাদের শিক্ষাকে আজ টাকা দিয়ে মাপতে শেখাচ্ছে। যত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানে পড়ালেখা করতে তত টাকা। কতজনেরই বা সাধ্য আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে নিজের সন্তানকে পড়ানোর। শিক্ষা এমন হতে হবে, যেন সার্টিফিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে মানবতার ছোঁয়া এনে দিতে পারে। ব্যর্থতা শিক্ষার হয় না, ব্যর্থতা হয় শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads