• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ভাসানচরে রোহিঙ্গা, হুমকিতে সন্দ্বীপ

ছবি : প্রতীকী

সম্পাদকীয়

ভাসানচরে রোহিঙ্গা, হুমকিতে সন্দ্বীপ

  • প্রকাশিত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

জিসান মাহমুদ

 

বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর নিয়ে বহুল আলোচিত দ্বীপ ভাসানচর। এক বছর ধরে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ভাসানচরে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ও বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা যেতে রাজি না হওয়ায় এত দিন স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজে করে রোহিঙ্গাদের ৪০ জনের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর পৌঁছায়। ২ দিন তারা আবাসন প্রকল্প ঘুরে সবকিছুতে সন্তুষ্ট হয়ে ৮ তারিখ কক্সবাজার ফিরে আসে। হয়তো অল্প কিছুদিনের মধ্যে সাড়ে ১১ লাখের ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু এতে ভাসানচরের নিকটবর্তী চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের কী অবস্থা হবে! একবারও কি ভেবে দেখেছি?

আমারা সবাই জানি, রোহিঙ্গারা খুবই বর্বর জাতি। প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, মারামারি, মুক্তিপণ, অপহরণসহ নানান ঘটনা ঘটছে রোহিঙ্গাশিবিরগুলোতে। কক্সবাজারে আসার পর এরা একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। বর্তমানে তাদের শত চেষ্টা করেও মিয়ানমার পাঠানো যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে শুধু দেশব্যাপী নয় অবৈধভাবে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে। কক্সবাজার শিবির থেকে গত মে মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচর পাঠানো হয়। যারা এখনো ওখানে অবস্থান করছে। যদি ভাসানচর এদের স্থায়ীভাবে জায়গা দেওয়া হয়, তাহলে ভাসানচর থেকে সন্দ্বীপ আসতে বেশি সময় লাগবে না। যতই নিরাপত্তা থাকুক না কেন! কারণ, নোয়াখালীর হাতিয়া সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বে এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ পশ্চিম প্রান্ত থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই ভাসানচর।

সন্দ্বীপ বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি দ্বীপ। দ্বীপের যেমন রয়েছে হাজারো ইতিহাস, তেমন রয়েছে খ্যাতি। দ্বীপের মানুষগুলো অত্যন্ত নম্রভদ্র। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে অপরাধ নেই বললেই চলে। অথচ এই দ্বীপ এখনো অবহেলিত। বর্তমানে যে ভাসানচর, মূলত এটা ছিল সন্দ্বীপের ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন ন্যায়ামস্তি। গুগল ম্যাপ দেখলে সহজে এটা বোঝা যায়। ১৯৫৪ সালে ৭৫টি মৌজা থেকে ১৫টি মৌজা নোয়াখালী জেলাকে ছেড়ে দিয়ে ৬০টি মৌজা নিয়ে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ৬৬ বছরে ন্যায়ামস্তি, ইজ্জতপুর, কাটগড়, বাটাজোড়াসহ অনেকগুলো মৌজা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ২০ বছর আগে জনমানবশূন্য ন্যায়ামস্তি তথা ভাসানচর আবার জেগে ওঠে। ভাসানচরকে সন্দ্বীপের থানা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্টে রিট এখনো চলমান। রিট আবেদনকারী মামলা নং-৭০৯৮/২০১৮-সহ ভূমিজরিপ, নদীজরিপ, নকশা ও খতিয়ান অনুযায়ী সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও গত বছর সন্দ্বীপের ন্যায়ামস্তি তথা ভাসানচরকে নোয়াখালীর বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। যেটা নিয়ে এখনো সন্দ্বীপবাসী আন্দোলন করে যাচ্ছে। নিজেদের ভূমি অন্যরা কেড়ে নিচ্ছে, অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না।

ভাসানচরে থেকে সন্দ্বীপ আসতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট, আর নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। যেহেতু সন্দ্বীপের একদম পাশেই ভাসানচর, সেহেতু সন্দ্বীপের জন্য রোহিঙ্গারা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এরা ঢুকতে বেশি সময় লাগবে না। একবার যদি সন্দ্বীপে প্রবেশ করে, তাহলে সন্দ্বীপ হবে রোহিঙ্গাদের মূল আশ্রয়স্থল। বেড়ে যাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। দ্বীপ এলাকা হিসেবে তাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না তখন। সন্দ্বীপকে তাদের সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলবে। আর তার দায়ভার পড়বে সন্দ্বীপবাসীর ওপর। আর না হয় সন্দ্বীপবাসীকে তখন নিজের জন্মস্থান রেখে পালাতে হবে। শান্তিপূর্ণ জায়গাটি হয়ে উঠবে দেশের সবচেয়ে অশান্তিপূর্ণ জায়গা। যেটা এখন কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফে হচ্ছে। একটি বিশেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ মানবিক হয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তার মানে এই নয় যে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গিয়েছে।

এ বিষয়ে ২০১৭ সাল থেকে ধারাবাহিক আন্দোলনে থাকা সন্দ্বীপ নাগরিক সমাজের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান বলেন, আমরা উক্ত স্থানান্তরপ্রক্রিয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কেননা, জন্মগতভাবে রোহিঙ্গারা অসভ্য জাতি। বাংলাদেশে প্রবেশের পর সন্ত্রাস, আন্তদাঙ্গা, ইয়াবা বিক্রিসহ নানান অপরাধকর্মে সম্পৃক্ত হয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। জড়িয়ে পড়েছে খুনাখুনিতেও। তিনি আরও বলেন, শরণার্থীদের দেশের সীমান্তে আশ্রয় দেওয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্ভবত বিশ্বে এটিই প্রথম। দেশের অভ্যন্তরে তাদের আশ্রয় দিলে আগামী এক যুগের মধ্যে তারা এদেশের নাগরিক হয়ে আলাদা স্বাধীন ভূখণ্ড দাবি করতে পারে। আমি মনে করি, এটি কেবল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সমৃদ্ধ দ্বীপ সন্দ্বীপের সমস্যা নয়। এটি এতদঞ্চলের বিশেষ করে সন্দ্বীপ, হাতিয়াসংলগ্ন সব কটি দ্বীপ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের সমস্যা। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ মিয়ানমারে স্থানান্তরে রাষ্ট্রতন্ত্রের চলমান কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও গতিশীল করতে হবে। কেননা, এভাবে চলতে থাকলে তারা স্বাধীন ভূখণ্ড দাবি করলে একসময় রাষ্ট্রতন্ত্রকেই এদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

বর্তমানে সন্দ্বীপের মানুষ বিক্ষুব্ধ। কেননা, একদিকে যেমন ভাসানচরকে নোয়াখালীর হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে হয়ে উঠছে আতঙ্ক। অথচ বর্তমান সময়ের এই অবহেলিত দ্বীপ প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, রেমিটেন্স বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছে। কয়েক দিন আগে সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য ভূমি বন্দোবস্তর অনুমোদন দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আকর্ষণীয় পর্যটনের অন্যতম একটি স্থান এই সন্দ্বীপ।

প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীনতম ৬৩০ বর্গমাইলের সন্দ্বীপ ভাঙনের শিকার হয়ে এখন মাত্র ৮০ বর্গমাইলে পরিণত হয়েছে। নদীভাঙনের কবলে পড়ে সন্দ্বীপের ভেঙে যাওয়া বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত মানুষ এখানে-ওখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আবার অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বেড়িবাঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাগরে চর জেগে ওঠা দেখে তারা আশায় বুক বেঁধেছে। পুরোনো ভিটায় আবার নতুন করে বসবাস করার সুযোগ হয়েছে, এই ভেবে। নদীভাঙা মানুষগুলো যেখানে আশ্রয় পেতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নিজেদের ফিরে পাওয়া বাপ-দাদার ভিটেমাটি রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল হবে, তা সন্দ্বীপবাসী মেনে নেবে না। ন্যায়ামস্তি তথা ভাসানচর সমুদ্রের মুখে অবস্থানের কারণে এর ভাঙন যেমনি দ্রুত ও স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটে, তেমনি মেঘনার অববাহিকার প্রবল স্রোতের সঙ্গে আসা প্রচুর পলিমাটি জমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আবার জেগে ওঠে। যার ফলে সন্দ্বীপের পশ্চিমে সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে বিআইডব্লিউটিয়ের নিয়মিত সার্ভিস জাহাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আগামী ২-৪ বছরের মধ্যে এই ভাসানচর সন্দ্বীপের সঙ্গেই হয়তো যুক্ত হবে বা যুক্ত করতে হবে। সবদিক বিবেচনা করে সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরিত না করা। অতি দ্রুত তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads