• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
করোনায় দুর্যোগ ও টেকসই উন্নয়ন

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

করোনায় দুর্যোগ ও টেকসই উন্নয়ন

  • প্রকাশিত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

জান্নাতুল মাওয়া নাজ

 

সারা পৃথিবী যখন করোনায় মারাত্মকভাবে আক্রান্ত, তখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল থাবা পৃথিবীর অনেক মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। বিজ্ঞানীদের সব প্রজেকশন দেখাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে জলবায়ু-সম্পর্কযুক্ত দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে, যা মহামারীর ক্রান্তিলগ্নে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং জনস্বাস্থ্যের রেসপন্সকে ছেদ করছে। করোনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পারফেক্ট কম্বিনেশনে উদ্ভূত কমপাউন্ড রিস্ক অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, ব্যবসা এবং শিক্ষাকে নজিরবিহীনভাবে প্রভাবিত করছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি অর্জনে অগ্রগতির ওপর গত ৩০ জুন একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৬৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। তবে অতি দারিদ্র্য নিরসনে সফল হলেও দারিদ্র্য নিরসনে সফলতার হার কম। ক্ষুধামুক্তির সূচকগুলোতে দেখা যায়, তিনটি সূচকে বাংলাদেশ ভালো করলেও দুটিতে স্থিতাবস্থায় ও দুটিতে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনায় কাবু। প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরই দেশের বড় একটি অংশ দীর্ঘমেয়াদি বন্যার মুখে পড়ে। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে এসডিজি অর্জনে দেশকে হতদরিদ্রমুক্ত করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার, তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তবে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ও বন্যার এ পরিস্থিতিতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন অব্যাহত রাখতে হলে কমপক্ষে এক কোটি মানুষকে ছয় মাস প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনে বাজেট পুনর্বিন্যাস করতে হবে। অর্থায়ন পুনর্বিন্যাস করে দারিদ্র্যের ওপর অনেক জোর দিতে হবে।

মানুষ প্রকৃতির ছোট্ট একটি অংশ। অথচ মানুষ যে হারে প্রকৃতিকে করায়ত্ত করার (বৃথা) চেষ্টা করেছে তা অচিন্তনীয়। করোনাভাইরাসকে অনেকে বলছেন ‘প্রকৃতির সমুচিত জবাব’, যার জন্য মানুষই দায়ী। কারণ মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎকে শোষণ করছে। করোনাভাইরাসের টিকা আজ না হয় কাল আসবেই, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষার্থে কোনো টিকা নেই। তাই জলবায়ু নিয়ে আমাদেরকে ভাবতেই হবে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন— বন্যা, খরা, সাইক্লোন, এবং হিট-ওয়েভ মোকাবিলায় প্রধানত স্ট্রাকচারাল এবং নন-স্ট্রাকচারাল (উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জমি ব্যবহারের পরিকল্পনা, বন্যা মনিটরিং ও জনগণকে সজাগকরণ) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা বা কমানোর জন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের প্রয়োগ বাড়াতে, যদিও এই সমাধানগুলোর ধারণা অপেক্ষাকৃত নতুন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) জোরেশোরে বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাকৃতিক সমাধান খোঁজার দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যাবশ্যক। একইভাবে, বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০ ও প্রকৃতিভিত্তিক সলিউশনের কথা হালকাভাবে বলছে।

প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান বলতে সাধারণত প্রকৃতি বা বাস্তুসংস্থানকে (ইকোসিস্টেম) ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবিলা করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। যেমন— বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদী, খাল ও বিল সচল রাখা এবং সাইক্লোন প্রতিরোধে বনাঞ্চল (যেমন সুন্দরবন) রক্ষা ও বাড়ানো। প্রকৃতিভিত্তিক, গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা নেচার-বেইসড সলিউশনের সামাজিক (জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন), অর্থনৈতিক (ট্যুরিজম ও এনার্জি সেভিংস) এবং পরিবেশগত (কার্বন স্টোরেজ ও হিট রিডাকশন) উপকারিতা বিশাল। এছাড়া এসব সলিউশনের কো-বেনিফিট (সহ-উপকারিতা) বিরাট, যা ক্লাইমেট অ্যাকশন এজেন্ডাকে (অভিযোজন ও প্রশমিতকরণ) অন্তর্ভুক্ত করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমায় এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ বাড়ায়। আবার নেচার-বেইজড সমাধানগুলো বায়ু, পানি ও শব্দদূষণ রোধ করে। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে এসব স্ট্র্যাটেজি বেশি দরকার। কেননা আমাদের গ্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ইনভেস্ট করার সীমাবদ্ধতা আছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রাক্কালে গ্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচার দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরোপুরি মোকাবিলা করা যাবে না, এটা প্রমাণিত।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক দেখিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা বা কমানোর জন্য পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের ওপর ইনভেস্টমেন্ট বেড়েই চলেছে। ২০১২-২০১৮ অর্থবছরে বন্যা ও বন্যার প্রভাব কমানোর জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নেচার-বেইজড সমাধানের ওপর ২২০ কোটি মার্কিন ডলার ইনভেস্ট করেছে (৩৪ প্রজেক্টে)। টাইফুন হাইয়ানের পর ফিলিপিন্স সরকার ম্যানগ্রোভ ও প্রাকৃতিক বিচ বন সংরক্ষণে ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০১১ সালের ভয়াল ভূমিকম্প ও সুনামির পর জাপান সরকার উপকূলবর্তী বন সম্প্রসারণে প্রায় ২২৫ কোটি জাপানিজ ইয়েন ব্যয় করেছে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে, ভিয়েতনাম উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছে, যা প্রায় ২১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রক্ষা করবে। সারফেস ফ্লাডিং নিয়ন্ত্রণে আরবান ডিজাইনে গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে প্রাধান্য দিয়ে চীন ৩০টি স্পঞ্জ সিটি তৈরিতে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণে জার্মানিও চীনের পথে হাঁটছে। আমাদের দেশের সঙ্গে খাপ খায়, এমন প্রকৃতিভিত্তিক সলিউশনের দিকে আরো বেশি করে বিনিয়োগ করা উচিত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন— বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর গতিপথ পরিষ্কারের জন্য উন্নত প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। নদীর নাব্যতা বাড়ানো কোথায় হবে ও কীভাবে হবে তা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক। এক্সপার্টরা বলেছেন, গভীরতা বাড়ানোর জন্য নদীর প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে।

বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধানে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ দরকার। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, খাল, বিল, হাওর ও অন্যান্য জলাভূমি দখলমুক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শহরের আশপাশে জলাভূমি ভরাট করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ অনেক জেলা শহরে বন্যা  নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী এবং আশপাশের এলাকার জন্য পরিকল্পনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। মোটকথা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাধান খুঁজতে হবে ব্যবস্থাপনায়।

করোনাকালে দেশের মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। বহু মানুষ গরিব হয়ে গেছে। আয় কমে গেলেও ব্যয়ের পরিমাণ একই রয়ে গেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এবং শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে। চলমান বন্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বলতে গেলে, এসবের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। তাই বন্যা, ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কর্মপন্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। বন্যাকালীন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য অপ্রতুল। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা না গেলে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক সংকট আরো তীব্রতর হবে।

টেকসই দুর্যোগ মোকাবিলা অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের ওপর। আইপিসিসির পঞ্চম অ্যাসেসমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সফল না হলে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত-সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

 

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ   

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads