• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তার বিকল্প নেই

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তার বিকল্প নেই

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

দুদিন আগে মিরপুর ১১ থেকে ২-এ যাব বলে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। রিকশাচালক ভাই এলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কত? তিনি যা বললেন তা থেকে আমরা কিছু টাকা কম বললাম। তিনি রাজি হলেন না। আমরা বললাম ঠিক আছে আপনি যান, আমরা দেখছি। তখনই লোকটা অনুনয় করে বললেন, ‘ভাই, করোনায় আমার চাকরি চলে গেছে। আমি উত্তরায় গার্মেন্টে ভালো একটি চাকরি করতাম। অর্ডার না পাওয়ায় কোম্পানি আমার মতো আরো অসংখ্য লোক ছাঁটাই করেছে। আমার মা হাসপাতালে, চিকিৎসায় অনেক টাকা প্রয়োজন। উপায়ান্তর না দেখে রিকশা চালাচ্ছি। আপনারা না গেলে টাকা পাব কোথায়? বিভিন্ন জায়গায় সিভি দিয়েছি। জানি না চাকরি কবে পাব।’ রিকশায় উঠতে দেরি করিনি। রিকশায় উঠে মনে মনে ভাবছিলাম, করোনায় পুরো পৃথিবীর চিত্রটাই ঠিক এমনই, একইরকম। ঠিক কত কোটি মানুষ এই মহামারীর কবলে পড়ে বেকার হয়েছে তার হিসাব কষা বড়ই দুঃসাধ্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে, যার মধ্যে প্রায় ১২ কোটি মানুষই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে ৫ কোটি মানুষ যা দেশের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য বেকার হতে পারেন। সবেমাত্র উন্নয়শীল দেশে পদার্পণ করা একটি দেশের জন্য এটি কত বড় বিপদ তা সহজেই অনুধাবনযোগ্য।

বৈশ্বিক এই মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখা আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ’২০ দুপুর ১টা পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৭ জন। এবার ভেবে দেখুন, যারা মারা গেলেন তারা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো চাকরি করতেন, আয় করতেন। পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট দিতেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির পরিবার থেকে নতুন করে কিন্তু কাউকে না কাউকে পরিবারের হাল ধরতে হবে। আর পরিবারের হাল ধরতে হলে চাকরি বা উপার্জনের পথ বের করতে হবে। প্রশ্ন হলো নতুন চাকরি এই মুহূর্তে দেবে কে? করোনায়তো পৃথিবীর সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত। সবখানে খরা। এমনিতেই ব্যক্তিমালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মচারী ছাঁটাই করছে। নতুন করে নতুন লোকদের কাজ দেবে কীভাবে?

বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা এতটাই নিম্নমুখী যে, বিগত সালের প্রায় সব রেকর্ডই ভেঙেছে। এর আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসে পুরো বিশ্বে ৪ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের ইবোলায় ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার ৩শ কোটি ডলার। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকেই করোনার কারণে চীনের ক্ষতি ৬ হাজার কোটি ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতির বাজার যারা চাঙা রাখেন বিশেষ করে আমেরিকা, জাপান ও চীন— এসব দেশের অর্থনীতির মন্দা মানে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে অন্ধকার। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা কী হতে পারে, সেটা গভীর ভাবনার বিষয়। ওইসিডির মহাপরিচালক এঞ্জেল গুরিয়া বলেছেন, এই মহামারী থেকে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে তার থেকে বেশি বড় হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এর আকস্মিকতা। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, কেউ যদি ভাবে দেশগুলো দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলে উঠতে পারবে, তাহলে সেটা হবে একটা ‘স্তোক বাক্য’। কাজেই সহজেই বলা যায়, এ ধাক্কা সামলানো বড় দায়।

তবে কি সব শেষ! মোটেও না। আমরা আশাবাদী। স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাঁটাযুক্ত পথেও হাঁটতে ভালোবাসি। সামনে ঘোর অমানিশার গাঢ় অন্ধকার জেনেও পিছিয়ে পড়ি না। সরকারের অবস্থান থেকে যা করণীয় হয়তো তাই করা হচ্ছে। কিন্তু একটি দেশের সরকার একা এমন ভয়াবহ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রান্তিক পর্যায়ের প্রতিটি মানুষকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শুধু চাকরির  পেছনে না ছুটে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। নিজে পরিশ্রম করতে হবে এবং অন্যকেও সুযোগ করে দিতে হবে। নিজে উদ্যোক্তা হতে হবে, অন্যকেও উদ্যোক্তা হতে পরামর্শ দিতে হবে। যদিও করোনায় অনলাইনভিত্তিক প্রচুর ব্যবসা চালু হয়েছে, যা বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। আশার কথা, এই বিপর্যস্ত সময়ে মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। আমার সঙ্গে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার ফেসবুকে বন্ধুত্ব রয়েছে। তাদের কার্যক্রম সত্যিকারার্থেই প্রশংসনীয়। আবার এর উল্টোচিত্রও রয়েছে। এখনো অনেক নারী আছে, যারা শিক্ষিত হয়েও চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরছে। চাকরি প্রাপ্তির আশায় আবেদনের পর আবেদন করেই যাচ্ছে। কিন্তু চাকরি নামক সোনার হরিণ তো এখন এই করোনার কারণে সাত আসমানের ওপরে উঠে চারদিকে মজবুত লোহার বেড়া দিয়ে বসে আছে। সে কি আর ধরা দেয়! অথচ তারা উদ্যোক্তা হতে ভয় পায়, লজ্জাবোধ করে। মেয়েদের কথা না হয় বাদই দিলাম। অনেক ছেলেরাও এখনো উদ্যোক্তা হতে সাহস পায় না। ঘরে খাবার নেই, চেয়ে থাকতে হয় সরকারের প্রণোদনার দিকে। অথচ নিজে কিছু করবে সেটাতেই যত আপত্তি। কেউ কেউ ধারণা করেন যে— কোনো একটা প্রফেশনেই লেগে থাকা উচিত। জানি না, এই করোনায় তাদের কী শিক্ষা হলো। আমার দেখা হাজারো শিক্ষক যারা শিক্ষকতা নামক মহান পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। স্কুল-কলেজের নির্ধারিত বেতনের পাশাপাশি প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং চালিয়ে খুব ভালোই চলতো তাদের। শুধু শিক্ষকতাই ছিল তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ। অথচ করোনা তাদের সব এলামেলো করে দিয়ে গেলো। বিশেষ করে যেসব শিক্ষকদের এমপিও হয়নি বা যারা ব্যক্তিগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, তাদের অবস্থা দুর্বিষহ। এটাতো গেলো মাত্র একটি প্রফেশনের কথা। কাজেই মনে করি, প্রতিটি মানুষের আয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো পথ অবশ্যই থাকা উচিত। বিপদের সময় পরিবার চালাতে যেনো অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। স্বাচ্ছন্দ্যে না হোক, কমপক্ষে পরিবার নিয়ে সুখে-দুখে দিন পার করার জন্যে হলেও বিকল্প কিছু শুরু করা উচিৎ। বলা তো যায়  না, করোনার পর আবার নতুন করে কোন মহামারীর মোকাবিলা করতে হয়।

কাজেই অর্থনীতির নিম্নমুখীর এই ভয়াবহ ধাক্কা সামলাতে হলে উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প দেখছি না। সরকার থেকে শুরু করে দেশের বিত্তশালীদেরও এলাকাভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে। পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সম্প্রতি অনলাইনে বাজারের নামে বড় বড় কোম্পানিগুলোর কিছু দুর্নীতির কথাও উঠে আসছে। এখানে সরকারের কড়া নজরদারি প্রয়োজন। এছাড়া হোম ইকোনমিকসে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সারাদেশে সরকারের অনেক আবাদি জমি অনাবাদিই থেকে যায়, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প আরো সহজ করতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একদিন এই অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যাবে। সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাত যতই গভীর হয়, সকাল ততই নিকটবর্তী হয়। প্রখর রোদের আলোময় হাসিমাখা সূর্য উঠবেই উঠবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads