• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ব্রিটেন ইইউ এবং ব্রেক্সিট

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

ব্রিটেন ইইউ এবং ব্রেক্সিট

  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

মো. রাশেদ আহমেদ

 

ব্রিটেন গত ৩১ জানুয়ারি ২০২০ সাল রাত ১১টায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ননের সাথে সুদীর্ঘ ৪৭ (১৯৭৩-২০২০) বছরের পথচলার অবসান ঘটিয়ে ‘একলা চলা’ নীতি গ্রহণ করেছে ব্রিটেনবাসী। যাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নতুন যুগের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। সেইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন, আগামী দিনে ব্রিটেনের বহুবিধ নয়া চ্যালেঞ্জের কথা। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের ফলে ব্রিটেনের নয়া চ্যালেঞ্জকে ইস্পাতের মতো আরো কঠিনতর করেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। অপরদিকে বিরোধী দলের প্রধান বৈচিত্র্যময় ব্রিটেন গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটিশ জনগণের মাঝে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় ২০১৬ সালের দিকে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরন ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে গণভোটের আয়োজন করেন। যেখানে প্রায় ৫২% ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেয়। যদিও ক্যামেরন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং পরে তিনি অনেকটাই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন।

দীর্ঘ দিনের চাপা ক্ষোভ ও বিভিন্ন কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসা ব্রিটেনবাসীর কাছে তাৎপর্য ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— অভিবাসীর চাপ থেকে দূরে থাকা, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চা করা, ইইউ’র বড় আর্থিক অনুদানে লাঘব টানা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি লাভ, বেকারত্বের হার কমানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বিশ্বের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য গড়ে তোলা, নিজ দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণ বৈষম্যের মতো ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এসব কারণে ব্রিটেনবাসী ইইউ থেকে সম্পর্কের ইতি টানার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ইইউ ত্যাগের ফলে আগামীতে ব্রিটেনের ঘরোয়া রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে এক রকম অস্বস্তি বিরাজ করবে, সময়ের পরিক্রমায় তা এখন সুস্পষ্ট। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্রিটেনের বড় একটা অংশ ইইউতে থাকার পক্ষে ছিল। এছাড়া উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেমন হবে তা মূলত স্পষ্ট নয়। সেইসঙ্গে স্কটল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে ইইউতে থাকতে আগ্রহী। এখন দেখার বিষয়, স্কটল্যান্ডের স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন কতদিনে পূরণ হয়। সন্দেহ নেই, ব্রিটেন বিশ্ব অর্থনীতির বড় একটি দেশ। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জিডিপির পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের নবম অর্থনৈতিক দেশ। ব্রিটেনের জনগণের মাথাপিছু আয় ৪৩ হাজার ৯০২ ডলারের মতো। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ব্রিটেনের অবস্থান বিশ্বে ১৩তম। বড় অর্থনীতি দেশের তকমার কারণে ইইউতে ব্রিটেনে আর্থিক অনুদানের পরিমাণও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এটি ব্রিটেনের অর্থনীতির জন্য এক ধরনের বড় বোঝা। যদিও ইইউ থেকে ব্রিটেন আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে, যার পরিমাণ অপ্রতুল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্তির কারণে প্রতিদিন ব্রিটেনের খরচ হয় ৫৫ বিলিয়ন পাউন্ড। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইউরোপীয় কমিশনের। যা সময়ের পরিক্রমায় এখন বিশ্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামে সুপরিচিতি। বর্তমান এ সংস্থাটি অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশ্বজুড়ে সমান অবদান রাখছে। সাধারণ হিসেবে ইইউ’র অর্থনীতির পরিমাণ প্রায় ১৬ দশমিক ২২ ট্রিলিয়ন ডলার যা বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতি। বিশ্ব জিডিপিতে ইইউ’র অবদান ১৫%। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যার অবদান প্রায় ২০%। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ১৯৯৯ সালে ১ জানুয়ারি একক মুদ্রা হিসেবে ডলারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও এতে ব্রিটেন যোগদান থেকে বিরত থাকে। ইইউ ত্যাগ করার ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে বড় ধরনের ঝাঁকুনির আশঙ্কা প্রকাশ করছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা। ‘র’র গবেষণার তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে ব্রিটেনের অর্থনীতি। এছাড়া ২০৩০ সালের দিকে ইউরোপে ব্রিটেনের বিনিয়োগের পরিমাণ কমবে প্রায় ৪৫% এবং বিদেশি বিনিয়োগ ২১ শতাংশ কমারও আশঙ্কা আছে।

বর্তমান বরিস জনসন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগামী দিনের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতিক দেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। যদিও এক্ষেত্রে ব্রিটেনের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল কিছুটা অন্তরায় হতে পারে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন করে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থির করা জরুরি হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, আগামী ডিসেম্বর মাসে ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্যিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে ব্রিটেনের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরবর্তী বর্তমান ব্রিটেনের রাজনৈতিক প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, একসময় দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে বিশ্ব শাসন করা ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থেকে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না। অথচ ব্রিটেন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য, পারমাণবিক ও সামরিক শক্তিশালী এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একটি দেশ। যেখানে ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খণ্ড খণ্ড হওয়ার পরও রাশিয়া আজ বিশ্ব রাজনীতিতে এককভাবে অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে আবির্ভাব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এখন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সুতরাং ব্রিটেনবাসী চায় বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে নিজের অবস্থান শক্ত করতে। এছাড়া ব্যাপক অভিবাসী ইইউভুক্ত দেশে বিশেষ করে বড় একটা অংশ ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়ার কারণে বেড়েছে সহিংসতা, মুসলিম বিদ্বেষ ও জঙ্গিবাদের মতো ঘটনা, যা ব্রিটেনের জনগণকে স্বাভাবিকভাবে মর্মাহত করেছে। এমনকি দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের প্রতি এসেছে বড় আঘাত। এটি মুক্তমনা ব্রিটেনবাসী খুব সহজে মেনে নেয়নি।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কারণ তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০% রফতানি হয় ইইউ দেশগুলোতে। যার বড় সুবিধা হলো বিনা শুল্কে ব্রিটেন এবং ইইউ দেশগুলোতে পণ্য পাঠাত বাংলাদেশ। এখান আর এ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যার ফলে ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক চুক্তি করতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও ব্রেক্সিট চূড়ান্ত কার্যকর হতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইউরোপের অনেক দেশ। যেখানে ব্রিটেনের প্রাণহানি এবং আক্রান্তের সংখ্যা নিছক কম নয়। এ ক্লান্তিলগ্ন সময়ে ব্রিটেনের পাশে ছিল না ইউরোপের কোনো দেশ। কার্যত দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও কোনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তেকেও এ দুর্যোগকাল সময়ে ইইউ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমনকি ইইউ থেকে বের হয়ে আসার হুমকি দেন, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যর্থতাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকট করে।

ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করে ‘একলা চলা’ নীতি অনুসরণ করার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বড় ধরনের নেতৃত্ব ও আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ইইউ’র প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ব্রিটেনের ন্যায় অন্য দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করে একলা চলা নীতি অনুসরণ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বলা যায়, এখন ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি নীতিমালা ও আইন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের আর ইইউ’র কোনো আইন বা নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে না। আগামীর প্রজন্ম বেড়ে উঠবে পুরাতন ব্রিটেনে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে। সেইসঙ্গে আগামী দিনে ‘একলা চলা’ নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্রিটেনবাসীকে এক কাতারে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অপরদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাজ হবে ইইউভুক্ত দেশগুলোর মাঝে সুসম্পর্ক ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সবার আস্থা অর্জন করা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads