• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া কতটা নিরাপদ

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া কতটা নিরাপদ

  • শরীফুর রহমান আদিল
  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০২০

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর কারণে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে গত ১৭ মার্চ থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত  দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার প্রকোপ না কমলে যেহেতু শিক্ষা কার্যক্রম সম্ভব নয়, সেহেতু অটোপাস ছাড়া উপায় নেই বলে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে দেশের সব শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সাধুবাদ জানালেও কিছু শিক্ষক (যারা একেবারেই বেসরকারি) ও শিক্ষা কর্মকর্তা এর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিরোধিতামূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতে, গার্মেন্ট, শপিংমল, মসজিদ ও বাজার খোলা থাকতে পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন খোলা যাবে না? তবে এদের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের কিছু শিক্ষা কর্মকর্তাও জড়িত, যারা গ্রাম পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে। গ্রামাঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়লেও তারা কেন এ ধরনের প্রস্তাব করেছেন, সেটা বোধগম্য নয়। তারা প্রতিবারই  দাবি করছেন যে, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। কিন্তু তাদের দেওয়া এমন যুক্তিগুলো মূলত বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটাই বিবেচ্য বিষয়। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন যা নিচে খণ্ডনসহ উপস্থাপন করলাম।

 

শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপা :  সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে প্রতিদিন ক্লাসে প্রবেশ করানো অনেকটাই অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। তাই সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করাতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। এছাড়া এর ধারাবাহিকতাও বজায় থাকবে না।

 

সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে যারা নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, তারা হয়ত জানেন না যে তাদের শ্রেণিকক্ষের আয়তন এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেমন?  আমাদের দেশে সাধারণত এক বেঞ্চে ৪-৫ জন করে বসে কিন্তু যদি এটি একজন এবং ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করানোর চেষ্টা করা হয়, সেক্ষেত্রে জায়গার সংকুলান হবে না। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গ নিরোধ করানোর চেষ্টা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।

 

স্কুল খোলার পরিণতি : অনেকে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, সেসব দেশে এমনকি গরিব রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাতেও বেঞ্চ-টেবিলের সমন্বয়ে তৈরি করা চেয়ার পদ্ধতি রয়েছে অর্থাৎ এক ছাত্রের জন্য একটি বেঞ্চ যা বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই। এছাড়া এসব পদ্ধতি থাকার পরও আমেরিকায় স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ। অন্যান্য দেশ প্রথমে সাহস করে স্কুল খুলে দিলেও করোনা আক্রান্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে পুনরায় স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

 

শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রমণ ঝুঁকি : শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এলে তাদের টিফিন, খেলাধুলা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা দারোয়ানের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গ নিরোধের প্রচেষ্টা চালাবেন? সবচাইতে বড় কথা হলো মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাওয়া-আসা করে দূরদূরান্ত থেকে। যার অধিকাংশের মাধ্যম হলো রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা ও সাধারণ যাত্রীবাহী বাস। ফলে এসব থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

 

শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থা না থাকা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষকই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন। ফলে এসব শিক্ষকের যাতায়াত, জেলা শহরের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেবে। যদিও বিভিন্ন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের আগে প্রত্যেক শিক্ষককে করোনা টেস্ট করা হবে এবং এতে নেগেটিভ শিক্ষকরা  পাঠদানে বিরত থাকবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি এক-দু সপ্তাহ করে তারপর হাল ছেড়ে দেবে। কেননা ফান্ডের সমস্যা, লোকবলের সমস্যা, সময়ের স্বল্পতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ প্রভৃতি দেখিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনা টেস্ট করানো থেকে বিরত থাকতে পারে। সুতরাং এ মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।

 

হাফেজি মাদরাসার সঙ্গে তুলনা :  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য তারা হাফেজি ও কওমি মাদরাসা খুলে দেওয়ার যুক্তি উত্থাপন করতে চান। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার, হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, খেলাধুলা এবং তাদের শিক্ষক সবাই একটা গণ্ডির মধ্যে থাকে। ফলে তাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই পরিস্থিতি কওমি মাদরাসার ক্ষেত্রেও, তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই এক জায়গায় বসবাস করে সুতরাং তাদের সেরকম ঝুঁকি নেই ।

 

বিভিন্ন দেশে স্কুল খুলে দেওয়ার প্রেক্ষিত : কিছুদিন আগে বিজনেস ইনসাইডার বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থায় খোলা হয়েছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে চীন, তাইওয়ান, ক্রোয়েশিয়া, জাপান, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, গ্রিস, ইসরাইল প্রভৃতি দেশের কথা বলা হয়েছে। সে বিশেষ ব্যবস্থা কী ছিল, তার ছবিসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ওয়াশিংটন পোস্ট। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব দেশে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে সেসব দেশে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান, প্রতিদিন বেঞ্চগুলো ধৌত করা, প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা এবং তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এগুলো শক্তভাবে তদারকি করেছে সেসব দেশের সরকার। এসব ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের জন্য অনেকটাই অসম্ভব। কেননা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত কিংবা প্রতিদিন সবাইকে পরীক্ষা করে তার ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে এসব দেশের মধ্যে কোনো কোনো দেশ তাদের দেশ করোনামুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। যেমন নিউজিল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও মন্টিনেগ্রো। আর অন্য দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ একেবারেই কম। আমাদের দেখতে হবে আক্রান্তের ভিত্তিতে যেসব দেশ শীর্ষে, তারা কি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে? যেমন ব্রাজিল। আবার যেসব দেশ তাদের স্কুল খুলে দিয়েছে, তাদের শিক্ষার্থীদের এন্টিবডি টেস্ট করলে ৩৪.৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর শরীরে এন্টিবডি লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ তারা করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ছিল। এত সচেতনতা এবং এত কঠোর ব্যবস্থাপনা হাতে নেওয়ার পরও গবেষকদের এহেন পরীক্ষা অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ভাবিয়ে তুলছে। সবচাইতে বড় কথা হলো, দেশের করোনা পরিস্থিতি আরো নাজুক হলেও মিড়িয়ার অনাগ্রহের কারণে এ বিষয়ে লোকজনের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা করোনার প্রথমদিকে কোথায় কোনো লোক মারা গেলে উপজেলা থেকে লোক এসে মৃত ব্যক্তির নমুনা নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করা হতো, যেটা এখন কোথাও দেখা যায় না। সুতরাং করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। তবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি আরো জোরদার করতে হবে এবং যেসব শিক্ষার্থীর ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের এটি কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট বিনামূল্যে দিতে হবে।

 

লেখক :  শিক্ষক ও গবেষক

adil.doc.info@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads