• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
জলাতঙ্ক নির্মূলে কুকুর নিধন নয়, টিকাদানই মুখ্য

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

জলাতঙ্ক নির্মূলে কুকুর নিধন নয়, টিকাদানই মুখ্য

  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০২০

আর এস মাহমুদ হাসান

 

‘জলাতঙ্ক’ বা ‘র‍্যাবিস’ হচ্ছে ভাইরাস গঠিত এক ধরনের জুনোটিক রোগ যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। লালা বা রক্তের মাধ্যমে এটি এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীর দেহে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রাণীর মধ্যেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। প্রধাণত কুকুরের মাধ্যমে রোগটি সংক্রামিত হয়ে থাকে। এখনো বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে ১ জন ও বছরে ৫৫ হাজার মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের।

ফ্রান্সের বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। এ টিকার প্রয়োগের ফলে জলাতঙ্ক রোগটি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। বিজ্ঞানীর মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস’। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য জলাতঙ্ক রোগের বিষয়ে পর্যালোচনা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। ২০০৭ সালে সর্বপ্রথম ‘বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস’ পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান’।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে জলাতঙ্কে আক্রান্তদের মধ্যে ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগই কুকুরের কামড়ের শিকার। এছাড়াও বিড়াল, শিয়াল, বেঁজি, বাঁদুর, ভোঁদড়, ইঁদুর ও বানর র্যাবিস ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে এবং মানুষসহ অন্য কোনো প্রাণীকে কামড়ালে, আঁচড় দিলে বা লালা কোনো ক্ষতস্থানে লাগলে এ রোগ হয়। তবে পশু কামড়ালেই জলতাঙ্ক হবে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। কারণ আক্রমণকারী পশুকে অবশ্যই জলাতঙ্কের জীবাণু বাহক হতে হবে। র্যাবিস ভাইরাস আক্রান্ত প্রাণীর কামড়ে ভাইরাসটি ক্ষতস্থান থেকে মস্তিষ্কে সংক্রমিত হয় এবং এতে স্নায়ুতন্ত্রের নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শ্বাস ও হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাতঙ্ক রোগে সাধারণত ১৫ বছরের নিচে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়। তবে আশার কথা হলো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য

র‍্যাবিস ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করলে জ্বর, ক্ষুধামন্দা, কামড় স্থানের অনুভূতিতে পরিবর্তন, যেমন— চিনচিন, ঝিনঝিন, কনফিউশন, অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা, লালারসের ক্ষরণ বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে ঢোক গিলার সময় ডায়াফ্রাম, রেসপিরেটোরি মাসল ও কণ্ঠনালির তীব্র ব্যথাযুক্ত সংকোচন হয়, বিশেষ করে জল পান করার চেষ্টা করলে ডায়াফ্রাম ও অন্যান্য ইন্সপিরেটোরি মাসলের তীব্র সংকোচন ও ব্যথা হয় ফলে রোগীর মধ্য হাইড্রোফোবিয়া তৈরি হয়। এ কারণে বাংলায় এই রোগকে জলাতঙ্ক নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়া রোগীর ডিলিউসন, হ্যালুসিনেশন ও পাগলামি, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়ানোর অক্ষমতা, চেতনাশূন্যতা দেখা দেয়।

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে কুকুরের কামড়জনিত জলাতঙ্কের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ এসডিজিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এজন্য বৈশ্বিক উদ্যোগের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জলাতঙ্ক রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ। এখনো দেশে বছরে ৫০ জনেরও বেশি লোক মারা যাচ্ছে এই রোগে। ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জলাতঙ্ক রোগের রিপোর্টিং জোরদারকরণ এবং মানুষ ও প্রাণীর জলাতঙ্ক নিশ্চিতকরণে ল্যাবরেটরি ডায়াগনোসিসের ব্যবস্থা উন্নয়নে সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাও কাজ করছে।

জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) এক বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জলাতঙ্ক রোগীর সংখ্যা ২১৪৭ থেকে ১৪৪৫-এ নেমে এসেছে। একইভাবে ২০১০-১১ সালে জলাতঙ্কে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর এ সংখ্যা ২০১৭-১৮ সালে কমে ৪৬ জন এবং ২০১৮-১৯ সালে ২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে ২০১০ সাল থেকে ব্যাপকহারে কুকুরকে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক দেওয়ার মাধ্যমেও জলাতঙ্কের হার কমতে থাকে। ওই বছর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

এ রোগে কেউ আক্রান্ত হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কুকুর কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কাপড় ধোয়ার ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান প্রবহমান পানিতে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধুতে হবে। এতে ৭০-৯০ শতাংশ জীবাণু মারা যায়। সাধারণত কুকুরে কামড়ানোর ৯ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয়। তাই লক্ষণ প্রকাশের আগেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। দংশিত কুকুরটিকে হত্যা না করে ১০ দিন বেঁধে বা আটকে রেখে চোখে চোখে রাখতে হবে। যদি কুকুরটি ১০ দিনের মধ্যে পাগল না হয় বা মারা না যায়, তবে বুঝতে হবে কুকুরটি জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত নয়। এতে কামড়ানো মানুষটিকে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। আর যদি কুকুরটি অসুস্থ হয়ে যায় বা পাগল হয়ে যায় অথবা মারা যায় অথবা নিখোঁজ হয়ে যায় তাহলে কামড়ানো মানুষটির চিকিৎসা করানো অবশ্যই দরকার। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতি দূর করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিকটবর্তী হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিতে হবে। বাজারে রাবিপুর নামে ইনজেকশন পাওয়া যায়। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ভ্যাকসিন নেয়া শুরু করলে ভয়ের কিছু নেই। কুকুর কামড়ানোর পরপরই টিকা নিয়ে মানুষ বেঁচে যেতে পারে। তবে অনেকেই টিকার তিনটি ডোজ সম্পন্ন করে না। যে কারণে টিকা নেওয়ার পরও অনেকের জলাতঙ্ক হয়। সুতরাং চিকিৎসা সম্পন্ন করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক।

কুকুরকে জলাতঙ্ক থেকে নিরাপদ করতে বিশ্বব্যাপী জলাতঙ্ক নির্মূলে ‘মাস ডগ ভ্যাক্সিনেশন’ বা ব্যাপক হারে কুকুরের টিকাদান কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। কোনো এলাকার ৭০ ভাগ কুকুরকে টিকা দিলে ওই এলাকার কুকুরের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়। তিন বছরে তিন রাউন্ড টিকা দিলে কুকুর থেকে মানুষ বা কুকুর ও অন্যান্য প্রাণিতে জলাতঙ্ক সংক্রমণের হার শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এ জন্য অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কুকুরকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। কুকুরকে টিকাদানের মাধ্যমে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদানই মুখ্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

mahmudhasi5188¦gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads