• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
লাদাখ সীমান্ত কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

লাদাখ সীমান্ত কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০২০

সোহেল দ্বিরেফ

 

 

লাদাখ সীমান্ত নিয়ে ভারত-চীনের মধ্যে বিরোধ নতুন কিছু নয়। এটা অনেক পুরনো ইস্যু। গত কয়েক বছর থেকে এই সীমান্তটি নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক কয়েকবার ওঠানামা করলেও ১৯৬২ সালের পর আর কখনো এত বড় সংকট তৈরি হয়নি, যতটা হয়েছে চলতি বছরের গত ১৫ জুনে। ২০০৩ সাল থেকে গত ১৭ বছরে ২২ বার উভয় দেশের কূটনীতিকরা আলোচনায় বসেছেন কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান আসেনি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, সীমান্তটি উভয় দেশের কাছেই কৌশলগত কারণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ একত্রেই ছিল কিন্তু তা বর্তমানে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। কারণ ভারতের সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কখনো পাকিস্তানের সংঘাত আবার কখনো লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে সংঘাতের ফলে এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। লাদাখ সীমান্তটি মূলত কাশ্মীর উপত্যকার পূর্বে অবস্থিত। এজন্য এই সীমান্তের কথা উঠলে সেখানে আপনাআপনি কাশ্মীরের কথাও উঠে আসে। জায়গাটি খুবই দুর্গম, এখানকার আবহাওয়া বসবাসের অনুকূলে নয়। তাছাড়া বারো মাস প্রচণ্ড শীত থাকে। এজন্য দীর্ঘসময় এখানে কেউ অবস্থান করতে পারে না।

ম্যাপ অনুযায়ী, ভারত ও চীনের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মাইল সীমান্ত রয়েছে। আগে উভয় দেশের মধ্যে বিবাদের কারণ ছিল অরুণাচল নিয়ে; কিন্তু এখন চীন সেটা থেকে নজর সরিয়ে লাদাখ সীমান্তে নিজেদের অবস্থান আগের যে কোনো সময় থেকে জোরদার করেছে। এখন তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা। যদিও চীন এখন বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটু ব্যাকফুটে আছে করোনাভাইরাসের কারণে। এজন্য তারা তাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দক্ষিণ এশিয়ার দিকে দিয়েছে। তারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে অর্থ সহায়তা দিয়ে বশে আনার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে নেপালকে কব্জা করেছে, হংকংয়ের আন্দোলনটি কঠিন হাতে দমন করেছে, বাংলাদেশকেও পাশে টানার চেষ্টা করছে এবং মিয়ানমার ও পাকিস্তান তো বহুকাল আগে থেকেই তাদের একান্ত অনুগত। সবকিছু মিলিয়ে তারা ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছে।

মূলত ভারতের লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা, গালওয়ান উপত্যকায় অবকাঠামো নির্মাণকাজ প্রসার করা এবং যোগাযোগের জন্য নতুন করে রাস্তা তৈরি করা— এসব চীন মেনে নিতে পারেনি। এছাড়া ভারত সেখানে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দ্রুতগতিতে কাজ করার অর্থ হলো, তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশটি মূলত চীনের নিয়ন্ত্রিত অংশটি থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু ও রুক্ষ। সুতরাং চীনা সৈন্যরা খুব সহজেই তাদেরকে নজরদারিতে রাখতে পারে। যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হলে ভারতীয় সৈন্যরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চীনা সৈন্যরা অপারেশন শেষ করতে পারবে। এজন্য বলা যায়, ভারতীয় সৈন্যদের তুলনায় চীনা সৈন্যরা বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। এটার সুযোগ নিয়েই তারা দখলদারিত্ব বাড়ানোর খেলায় মেতে উঠেছে। অবশ্য ভারত চাইলে এই সংঘাত বহু আগেই শেষ করে দিতে পারত, যদি তারা ১৯৬০ সালে চীনের দাবিটি মেনে নিত। তারা প্রস্তাব রেখেছিল, আকসাই চীনের বিনিময়ে অরুণাচলের ওপর দাবি সরিয়ে নেবে এবং আকসাই চীনে তাদের সার্বভৌমত্ব মেনে নিলে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতের নিয়ন্ত্রণও মেনে নেবে। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সেটা মেনে নিলে হয়তো ভারতকে এত দুশ্চিন্তায় দিন পার করতে হতো না।

চীন যে কোনো মূল্যে চাইবে গালওয়ান উপত্যকায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে। চীনের আগ্রাসনকে ডিফেন্স করার মতো এখনো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি ভারতকে। এই ঘটনাটি যদি পাকিস্তানের সঙ্গে ঘটতো, তাহলে জবাব দিতে হয়তো এতটা সময় নিত না। কিন্তু তাদের চুপচাপ অবস্থা দেখে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তাহলে ভারতের লৌহমানবখ্যাত নরেন্দ্র মোদি কি পরোক্ষভাবে পরাজয় বরণ করে নিলেন, নাকি সংঘাত এড়াতে শান্তির পথে হাঁটতে চাচ্ছেন— সেটা সময়ই বলে দেবে। যদিও ভারতের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র বার বার বলে আসছে তারা ভারতের পাশে আছে; কিন্তু ভারত আদৌ তাতে স্বস্তি পাচ্ছে না। কারণ কোনোভাবে চীনের সঙ্গে যুদ্ধটা বেধে গেলে যুক্তরাষ্ট্র কতটা এগিয়ে আসবে বা কতটা সামরিক সহায়তা দেবে তা নিয়েও সংশয় আছে। এজন্য তারা আপাতত ওই পথে হাঁটছে না। এদিকে চীন যতই লাফালাফি করুক না কেন, তারাও মন থেকে চাইবে না যুদ্ধ হোক। কারণ যুদ্ধে ভারতের যতটা না ক্ষতি হবে, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে চীনের। গত কয়েক বছর তারা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে যতটা অগ্রগতি করেছে সেটা ঈর্ষণীয়। এখন একটা ভুল চালে তাতে ভাটা পড়ুক এটা নিশ্চয়ই তারা চাইবে না, এজন্য তারাও সতর্ক।

সম্প্রতি সীমান্তে শান্ত পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্যে উভয় দেশ কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। বৈঠকে উভয় দেশ শান্ত থাকবে বলে কথা দিলেও কার্যত তা দেখা যাচ্ছে না। এজন্য সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, চীন কি ভারতের সঙ্গে লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চূড়ান্তভাবে মধ্যস্থতা করবে, নাকি নিজেদের আগ্রাসী মনোভাব বজায় রেখে দখলদারিত্বের খেলায় মেতে উঠবে? আর যদি এমনটা চলতেই থাকে, তাহলে ভারতের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তারা যে কোনো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেও পারে। এর ফলাফল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা সংকীর্ণ হয়ে আসবে। সময়ই বলে দেবে সব প্রশ্নের উত্তর।  

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads