• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভাস্কর্য ও শিশুস্বর্গের সোনার বাংলা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

ভাস্কর্য ও শিশুস্বর্গের সোনার বাংলা

  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২০

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম

 

 

ধরণিতে কেবলই প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিল যে শিশুটি সে পলিযুক্ত কাদামাটির মতো! একজন ভাস্করের কাছে এমন কাদামাটি এলে তিনি সেটা দিয়ে যেমন পূজনীয় দেবদেবীর মূর্তি বানাতে পারেন, তেমনি পারেন একজন কুখ্যাত শয়তানের মূর্তি বানাতে। নির্ভর করে ওই ভাস্কর কোন দেশের, কোন সমাজের, কোন পরিবার এবং কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছেন। কোন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে তিনি বাল্যকাল থেকে শিক্ষাকাল কাটিয়েছেন, আর কোন ধরনের বন্ধুসঙ্গে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন। এমনকি কোন ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে তিনি বাস্তব জীবনকে উপলব্ধি করেছেন। আর সেইসাথে তিনি কোন ধরনের বই-পুস্তক চর্চা করেছেন এমনই সব বিষয়ের ওপর।

এতকিছুর অবতারণা করেছি এজন্য যে, শৈশব কৈশোর যৌবনে যে সকল বিষয় তার মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করেছে সেসব বিষয়ের সমষ্টিযোগে তার চিন্তা-চেতনা ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে সৃষ্টিশীল কাজে সে বিষয়ের ছাপ পড়ে থাকে তার সৃষ্টিকর্মে। ব্যতিক্রম রয়েছে কিছু।  সে আলোচনায় যেতে চাই না। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার বাইরে আত্মকর্ষণমূলক উপলব্ধি থেকে অনেক মূর্ত-বিমূর্ত, ছায়া-প্রচ্ছায়ার জন্ম হয়েছে যা সাধারণ থেকে ভিন্ন সত্তা লাভ করে কখনো কখনো হয়ে উঠেছে অসাধারণ।

প্রসঙ্গক্রমে সকল ক্ষেত্রে কিংবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাদের জীবনে ভালো সংস্কৃতির দেখা মিলেছে তারা সঙ্গত কারণেই এই কাদামাটি দিয়ে সুন্দর প্রতিমা বা ভাস্কর্য তৈরি করবেন সেটি স্বাভাবিক। তেমনি করে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি এ গ্রহের যে অঞ্চলে যে বাবা মায়ের কোলে চাঁদের হাসি নিয়ে আসলো তার প্রাথমিক নার্সিং শুরু হয় পরিবারে। পিতা-মাতা, পরিবার যদি সুন্দর হয় সুশিক্ষিত হয়, ভালো মানুষ হয় তবেই শিশুটির জীবন যাত্রা শুরু হয় ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার লক্ষ্যে।

অন্যথায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট পরিমিতি করে যদি তার জীবন গঠনের কোনো পরিষ্কার কাঠামো তৈরি করা যায় এবং সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বাবস্থায় তাদের একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে মা-বাবার পাশাপাশি সমাজ রাষ্ট্র অনেক বেশি দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে একজন সুনাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে। কাজেই শিশুটি কোথায় জন্ম নিল সেটিও বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফিনল্যান্ডে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত একজন শিশু-কিশোরকে কোনো রকম পরীক্ষা পদ্ধতির মুখোমুখি হতে হয় না। এতটা সময়ের মধ্যে একজন শিশুর চিন্তার জগৎ কেমন তা শিক্ষকরা খুব চমৎকারভাবে নির্ধারণ করেন। অতঃপর তাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন অনুসারে বিশেষায়িত শিক্ষা জীবনের দিকে পরিচালনা করা হয়।

জেনে রাখা প্রয়োজন সে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের মধ্যে যারা একেবারেই প্রথম সারির তাদের মধ্যে থেকে সেরাদের বেছে নিয়ে উচ্চ বেতনে পুরো এক বছর ট্রেনিং করিয়ে অতঃপর তাদের মধ্য থেকে সেরাদের বেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একবার ভেবে দেখুন তো সে দেশের সন্তানেরা সুসন্তান কিংবা সুনাগরিক হবে না কেন?

আমাদের দেশের চিত্র পুরোটাই তার উল্টো। আর ঐ সকল দেশে অপরাধ প্রবণতা এতই কম যে, জেল সিস্টেম সেখানে কার্যকরী নয় বললেই চলে। সেখানে আমাদের চিত্রটা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ একটাই- আমরা জেনেশুনে প্রায় সবকিছুতে বিপরীত পথে চর্চা করছি। কাজেই আমাদের শিশু-কিশোররা যাদের হাত ধরে যে পরিবেশে যে শিক্ষা পাচ্ছে, যাদের দ্বারা শিক্ষা পাচ্ছে বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে আর যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বেড়ে উঠছে তাতে ভয়ংকর গ্যাং তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।

সাত কোটি মানুষের দেশে এখন সতেরো কোটি মানুষের বাস। বর্ধিত জনসংখ্যার বেশিরভাগই যে মন্দ কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পরবর্তীতে তা বলতে গবেষণার প্রয়োজন নেই মনে করি। বরং গাণিতিক হারে ভালো মানুষের সংখ্যা যেমন কমে গেছে, তেমনি জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে মন্দ মানুষের সংখ্যা। ফলে বিভিন্ন সূচকে উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও চরম অবনতি হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নে তথা সুনাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে। অথচ সুন্দর প্রাপ্তির প্রত্যাশা পূরণে এটিই পূর্বশর্ত। তুমি সব কিছুতেই সুন্দর খুঁজে পেতে পারো কেবল যদি তুমি সুন্দর মানুষ গড়ে তুলতে পারো। আর এ সুন্দর মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বছরের এদেশে আমরা কোনোভাবেই সফল হতে পারিনি। সেইসাথে আমাদের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটিও এমন প্রত্যাশিত সুন্দরকে প্রকাশ করে না।

শিক্ষা ব্যবস্থায় কত ভিন্নতার পরিচয়। শহরে গ্রামের কত পার্থক্য। যারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন কত ন্যূনতম যোগ্যতা নিয়ে আর সরকারিভাবে যে সকল প্রকল্প এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা দিয়ে কতটুকুই বা সম্ভব সুনাগরিক গড়ে তোলা সেটিও ভাবা দরকার। মনে রাখা দরকার বেসিক ইনপুট সুন্দর না হলে আউটপুট সুন্দর প্রত্যাশার কোনোই কারণ থাকতে পারে না। তদুপরি মেধা বিকাশের সহায়ক খেলাধুলার মাঠ, নদী-নালা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এগুলো তো চোখের ওপর ঘটতে দেখলাম এমন বিপ্লব যে অবারিত শিশুজগৎ আজ বাধ্য হয়েই ঘরবন্দি থেকে বড় হচ্ছে।

যাদের জন্য এত বাহ্যিক উন্নয়নে আমরা যতটা মহাব্যস্ত, তাদের মননশীলতায় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা ততটাই উদাসীন। বর্তমানে গড়ে ওঠা খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সবকিছুই আজ শিশুদের মনোবিকাশের বিপরীতে। এমনকি এতটা অল্প বয়সি শিশুদের কাঁধে চেপেছে এতটা ভারী ব্যাগ যে তার নিজের ওজনের চেয়েও বেশি। আর অসম্ভব প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার ভিত্তিতে অনেক অভিভাবক নকল নীতি বা টাকা পয়সা খরচ করে ভর্তি কোচিং নানা চাপে অঙ্কুরেই শিশুকে ধ্বংস করছে। কাজেই এ শিশু বড় হয়ে দেবতা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, তা সহজে অনুমেয়।

তদুপরি যারা পরিবার থেকে শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে পুনরায় বাস্তব জীবনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে তারা সকল ক্ষেত্রেই এমন ভাস্করের সান্নিধ্য পাচ্ছে যারা সকলেই শয়তান তৈরিতে অতি দক্ষ। কালেভদ্রে দু-একজন ব্যতিক্রমী হয়ে দু-একটা দেবী মূর্তি বানাতে পারেন মাত্র। আর তাদের ওপরে ভর করেই চলছে দেশের উন্নয়ন জয়যাত্রা। কাজেই উন্নয়ন করতে হলে সুনাগরিক গড়ে তোলা যেমন পূর্বশর্ত, তেমনি সেটি যথাযথ গুরুত্বের সাথে গড়ে তোলার চেষ্টা না করলে ঐ রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব কি করে?

জানি কাজটি সহজ নয়। যেহেতু মন্দ দিয়ে ভরে গেছে চারপাশ। কাজেই এখানে যতটুকু সম্ভব শুধরানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, তার চেয়ে জরুরি আগামী বা আগত শিশুদের ক্ষেত্রে সবাইকে একইভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজন, সরকারি নতুন কোনো আধুনিক ব্যবস্থাপনায় এই শিশুরা বেড়ে উঠুক শিক্ষিত হোক সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে দেশের দায়িত্ব বহন করুক। আর তা করতে যদি প্রয়োজন পড়ে আমরা যারা শয়তান বানানোর ভাস্কর তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুক। কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়ই এটি সম্ভব। সকল শিশু হোক রাষ্ট্রীয় শিশু। আগামীর সুনাগরিক সুন্দর ভাস্কর- তাদের হাতে গড়ে উঠবে আমার সোনার বাংলা।

 

 লেখক : পুলিশ সুপার, প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads