• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি

  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২০

শাহীন চৌধুরী ডলি

 

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে.../...স্বাধীনতা আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।/ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা। যুদ্ধে ধর্ষণকে অস্ত্রের মতো একটি হাতিয়ার হিসেবে শত্রুপক্ষ ব্যবহার করেছিল সেদিন। মা-বোনদের সতীত্বের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজও ধর্ষিতার কাতর চিৎকার।

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। স্বামীকে বেঁধে সেই তরুণীকে ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নামধারী কুলাঙ্গাররা ধর্ষণ করে। স্ত্রীর চিৎকারে অসহায় স্বামী যন্ত্রণায় ছটফট করলেও ধর্ষণ থেকে স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে মা-বাবাকে বেঁধে পাহাড়ি তরুণীকে গণধর্ষণ করেছে ৮-৯ জনের দুর্বৃত্তের দল। এই ঘটনাগুলোর প্রতিবাদে সরব যখন দেশের সাধারণ মানুষ, ঠিক তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও সবাইকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে নিজ ঘরে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে চার যুবক। এ ঘটনার ভিডিও করে পরে তা ভাইরাল করে দিয়েছে। রোববার (৪ অক্টোবর ২০২০) গৃহবধূকে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে নিন্দার ঝড় ওঠে। অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ভুক্তভোগী পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ভিটেমাটি ফেলে নির্যাতিত পরিবার ধর্ষকদের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে।

ধর্ষণের পর হত্যা করে তনুর লাশ ধর্ষক-খুনিরা দুর্দান্ত সাহসে কুমিল্লা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল। ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সারাদেশে আলোচনার ঝড় তুলেছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটেছিল নোয়াখালীর সুবর্ণচরে। ধর্ষণের শিকার চার সন্তানের জননী। ওই ঘটনা দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।এমন আরো বহু ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এমন সব পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা।

সামাজিক ব্যাধি ধর্ষণের ভয়াবহতা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বত্র ধর্ষণ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে জোরালোভাবে ধর্ষকের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা তিমিরেই রয়ে গেছে। প্রাত্যহিকভাবে নারী নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা যেন। কন্যাশিশু থেকে বয়স্ক নারী নিজের ঘরে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, যানবাহনে, পার্কে, রেস্তোরাঁয়, সৈকতে কোথাও আজ নিরাপদ নয়। দিন কিংবা রাত একশ্রেণির নরপশু যেন শিকার ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। অনেক ধর্ষক ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত না হয়ে বরং তারা খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্রে ধর্ষকের শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও বর্বরোচিত ঘটনা কেন বেড়েই চলেছে? তবে কি আইন কেবল কাগজপত্রেই আছে, বাস্তবে এর প্র‍য়োগ নেই? কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই, অবস্থাটা এমনই। আত্মমত্ত প্রশাসন নিরোর বাঁশি হাতে তুলে নিয়েছে যেন!

মূলত অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতির বেসামাল প্রভাব, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দেশে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ধর্ষণ ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে পড়ে আছি। ধর্ষণের শিকার একজন নারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাবোধ হারিয়ে ফেলে। কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও পরিবারে, সমাজে নিগৃহীত হয় ভিকটিম। ধর্ষণের শিকার অনেক বিবাহিত নারীকে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন আর ঘরে তুলে নিতে চায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েটি স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হয়। ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করলে ধর্ষক কর্তৃক হুমকির সম্মুখীন হয়। আদালতে প্রতিপক্ষের উকিলের জেরার মুখে পুনঃপুন ধর্ষিতা হয় ভুক্তভোগী নারী। ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী ধর্ষণের বিচারের সময় অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমলের পক্ষে ৬-৭ জন উকিল ছিলেন যারা আদালতে নির্যাতিত ছাত্রীর শারীরিক গঠনের বর্ণনা দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন ওই মেয়ের সম্মতি ছাড়া শিক্ষক কাজটি করেনি। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ধর্ষণের শিকার নারীকে আদালতে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয় এবং এর সুযোগ নেয় ধর্ষকের আইনজীবীরা। ধর্ষণের শিকার নারী বিচার চাইতে গেলে পদে পদে ধর্ষিত হন।

আইনের শাসন ধর্ষণ রুখতে পারছে না। অনেক বছর ধরেই কঠোর আইনকে ধর্ষণের প্রতিকার ভাবা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ ও নানা সামাজিক অপরাধে খুব গভীরভাবে রাজনীতির যোগ রয়েছে। রাজনীতি ও ক্ষমতার যোগ ছিন্ন না হলে এসবের ব্যাপকতা থামানো সম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলছে। বাংলাদেশে বহু সিরিয়াল রেপিস্টের কথা আমরা জানি। সেঞ্চুরি মানিকের কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ধর্ষক মজনু মাদকাসক্ত এবং সিরিয়াল রেপিস্ট— র‍্যাব এমন অভিমত ব্যক্ত করেছে। গ্রেপ্তারের পরেও ধর্ষকের বিচার নিয়ে সন্দেহ থাকে। বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলার মাত্র তিন শতাংশ ঘটনায় অপরাধী শাস্তি পায়। ধর্ষণের পর হত্যায় শাস্তি পায় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ অপরাধী। ধর্ষিতা শতভাগ নারীকেই পরবর্তী জীবনে ভুক্তভোগী হয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিচারব্যবস্থা আধুনিক করে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ধর্ষককে পারিবারিক বা রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাড় দেওয়া যাবে না। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি অসম্মানজনক যেকোন ধরনের মামলা নেওয়ার ব্যাপারে পুলিশকে তড়িৎকর্মা হতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০’-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করে তাহলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হবে।’ আইনে আছে, কোনো শিশু বা  নারী ধর্ষণের পর মারা গেলে ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড হবে। শতকরা ৯৭ ভাগ ধর্ষণ মামলায় বাস্তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে বলেই অপরাধীরা আইনকে তোয়াক্কা করে না। বিবেকবান প্রতিটি মানুষ ধর্ষকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। নারীর মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান অনস্বীকার্য। খুন ও ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ চাই। আসুন আমরা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হই। সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশের সর্বত্র, সবখানে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

shaheen.babu1971@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads