• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
এইচএসসি পরীক্ষা : কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও শতভাগ শিক্ষার্থীবান্ধব

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

এইচএসসি পরীক্ষা : কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও শতভাগ শিক্ষার্থীবান্ধব

  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০২০

মো. শরীফুর রহমান আদিল

 

শিক্ষার্থীদের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সরকার এ বছরের এইচএসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের নিকট এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাইরে বিকল্প কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না এবং  সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। কেননা, করোনার মধ্যে সবকিছু খোলা রাখলেও কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে না কিংবা এইচএসসি পরীক্ষা হবে না, বিভিন্নজনের এমন বিরূপ মন্তব্যের দিকে না তাকিয়ে সরকার তার দেশের আগামীর কাণ্ডারীদের কোনো বিপদে কিংবা ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি। মূলত পরীক্ষা নিতে গেলে কিছু শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হবে না-এমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? যে যত কথাই বলুক না কেন,  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ বিষয়টি সঠিকভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই। সুতরাং এমুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিল না সরকারের কাছে।

আমাদের দেশে অটোপাশের ইতিহাস এটাই যে প্রথম তা কিন্তু নয়; বরং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অটোপাশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও আইয়ুব খানের আমলে স্নাতক কোর্স তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করতে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পাঠরতদের পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হয়েছিল স্নাতক ডিগ্রি। পরদিন সকালে পত্রিকার মাধ্যমে তারা জানতে পারেন যে তারা সবাই স্নাতক তথা গ্রাজুয়েট হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ তখন একে মর্নিং গ্রাজুয়েট বলে থাকেন। তবে করোনা মহামারীতে কেবল বাংলাদেশ যে অটোপাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিন্তু নয়; বরং ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বেশকিছু দেশ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর অন্য দেশসমূহ এতটা পরীক্ষানির্ভর নয়।

অনেকে হয়তো এ সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক হিসেবে দেখবেন। কেননা, আমাদের দেশে শিক্ষাটা পাবলিক পরীক্ষানির্ভর। সমালোচনাটাও তাই পরীক্ষা নেওয়ার কারণে। অনেকে বলেন, কোনো কোনো শিক্ষার্থীর জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো হয়নি কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো করার প্রস্তুতি ছিল; এ থেকে কিছু শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল থেকে বঞ্চিত হতে পারে। পাশাপাশি এটাও তো সত্য যে, এর বিপরীতও হতে পারত। তা নাহলে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে গত বছর প্রায় ৩ লাখ শিক্ষার্থী কেন ফেল করল? তাদের তো আরো বেশি জিপিএ পাওয়ার কথা ছিল?  সুতরাং এই সিদ্ধান্তটি ভুল এমন বলা যাবে না এবং শতভাগ নির্ভুল এটাও বলা  যাবে না। তবে কমিটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে এ সমস্যা উত্তরণ করা শতভাগ সম্ভব এবং শিক্ষার্থীরা কোনোক্ষেত্রেই বঞ্চিত হবে না বলেই বিশ্বাস করি।

যারা এধরনের সমস্যার কথা উল্লেখ করেন তাদের গতবছরের তিনটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের দিকে নজর দেওয়া উচিত। অর্থাৎ, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এধরনের যুক্তি বিশ্বাস করার কোনো হেতু থাকে না। কেননা, ২০১৫ সালে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় মোট অংশগ্রহণকারী ছিল ২২ লাখ ৭২ হাজার ২৮৯ জন এবং ৯২.৩৩ শতাংশ পাশ নিয়ে সে বছর জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৬৩ জন, যাকে শতকরায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় ৮.৬৩ শতাংশ। জেএসসি-জেডিসিতে উত্তীর্ণরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ২০১৭ সালে, তখনকার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬১৩ জন, যার ৮১.২১ শতাংশ পাশ করে মোট  জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন। আর জিপিএ-৫ কে শতকরায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় ৫.৮৬ শতাংশ  এবং ২০১৭ সালে এসএসসিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ২০১৯ সালে এইচএসসির ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে বছর ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭৩.৯৩ শতাংশ  পাশ করে এবং ৪৭ হাজার ৫৮৬ জন ‘এ’ প্লাস পেয়েছে যার শতকরা হলো ৩.৫৬। এবার চলুন যারা উপরিউক্ত যুক্তি দেয় তাদের যুক্তিটা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? আরেকটু সহজ করে বলি, ২০১৫ সালে জেএসসিতে জিপিএ-৫ ছিল ৮.৬৩% যেটি এসএসসিতে এসে দাঁড়ায় ৫.৮৬% এবং এইচএসসিতে আরো কমে দাঁড়ায় ৩.৫৬%।  পাশের হার বিবেচনা করলে দাঁড়ায় ২০১৫ সালে জেএসসিতে ৯২.৩৩% যা ২০১৭ সালের এসএসসিতে পাশের হার ৮১.২১% এবং ২০১৯-এ এইচএসসিতে এ ফল দাঁড়ায় ৭৩.৯৩%। উপরিউক্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, জেএসসি ও এসএসসিতে যে হারে ভালো ফলাফল করে  এইচএসসিতে তার চেয়ে পাশের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কম থাকে।  সুতরাং উপরিউক্ত যুক্তিটি ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এবার আসি এবছর অটোপাশ দেওয়ার কারণে কী পরিমাণ জিপিএ-৫ পেতে পারে, সেই হিসাবে। তবে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা ২০১৬ সালে জেএসসি ও ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সুতরাং সেখানে তাদের জিপিএ-৫ এর হার কেমন ছিল?  ২০১৬ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫৮৮ জন যা শতকরা হিসাবে ১২.২৫ শতাংশ এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন বা ৫.৪৬  শতাংশ। দুটিকে গড় করলে এবার এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেতে পারে ৮.৮৬ শতাংশ যা গতবারের তুলনায় ৫.৩০ শতাংশ বেশি। এছাড়াও এবছর যেহেতু শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা হবে, সেক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১০-১২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে এবং জিপিএ-৪ থেকে ৪.৯০ পেতে পারে প্রায় ৬০ শতাংশ। সুতরাং কোনো শিক্ষার্থী বঞ্চিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না বরং সবারই ফলাফলের ক্ষেত্রে লাভই হবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।

আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে পরীক্ষা নেওয়া থেকে মূল্যায়ন ব্যবস্থা অনেক উন্নত। অন্যভাবে বলা যায়, পরীক্ষার মাধ্যমে তো আর  শিক্ষার্থীর শিখনফল কতটুকু শিখছে তা পরখ করা যায় না। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল প্রশ্নোত্তরে সৃজনশীল উত্তর লিখছে কিনা সেটা বর্তমান পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় দেখা সম্ভব নয়। অটোপাশ না দিয়ে সরকার যদি পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে থাকত, তবে এ পরীক্ষা অবশ্যই করোনামুক্ত হওয়ার পর হতে হতো। সে হিসেবে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দেড়-দুই বছরের শিক্ষাজীবন নষ্ট হওয়ার আশংকা ছিল। অথচ এখন অটোপ্রমোশনের ফলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু করে দিতে পারবে এবং তাদের জীবন থেকে মূল্যবান একটি অথবা দুটি বছর হারিয়ে যাবে না। এত কিছুর পরও অটোপাশের কারণে কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, যেমন—শিক্ষার্থীদের নিকট কেন্দ্র ফিসহ ফরম ফিলাপের সময় নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক, গত বছরের ফেল করা শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো কীভাবে পাশ করানো হবে সেটা স্পষ্ট করতে হবে; বিভাগ পরিবর্তন করে যারা ভালো ফলাফলের আশায় অন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে তাদের জন্য স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে ফলাফল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কাজ করতে হবে; আর বিভাগ পরিবর্তন না করা শিক্ষার্থীদের এইচএসসিতে এমন অনেক বিষয় ছিল যা এসএসসিতে ছিল না, সেসব বিষয়ের মূল্যায়ন কীভাবে হবে তা স্পষ্ট করা ও একই সঙ্গে যদি সম্ভব হয় তবে তার কলেজে পড়াকালীন সব পরীক্ষার ফলাফলের গড় করে তার সঙ্গে কিছু গ্রেস দেওয়া; যদি জেএসসি-এসএসসি পরীক্ষার নাম্বারের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন করা হয়, তবে যারা টেস্টে কৃতকার্য হতে পারেনি তাদেরও মূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত; এসব শিক্ষার্থীরা যাতে পরবর্তী কোথাও চাকরি ও দেশে-বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এবং যেহেতু এ বছর ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন সবাই পাশ করবে, তাই তাদের উচ্চ শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যদিও দেশে উচ্চ শিক্ষার আসন প্রায় ২০ লাখ ।

তবে সরকারকে এ ধরনের অটোপাশ দেওয়া থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং শিক্ষকতায় মেধাবীদের প্রবেশে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শিক্ষকদের উন্নত বেতন প্রদান, প্রশিক্ষণ, নৈতিক উন্নয়নে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। উপরন্তু শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন সঠিক ও নৈতিকভাবে যাতে করতে পারেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষায় বৈষম্য ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।

সবশেষে বলবো, অটোপাশ নিয়ে এখন যে সমালোচনা হচ্ছে তার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার আয়োজন করতে গেলে তার চাইতেও আরো বেশি সমালোচনা এবং পরিবেশ উত্তপ্ত হতো। সুতরাং উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ ও পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক এবং এটি বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা অতিক্রম করতে পারলে তা হবে যুগান্তকারী।

 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

adil.doc.info@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads