• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

উঁকি দিচ্ছে পাটের স্বর্ণালি সম্ভাবনা

  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০২০

নওরিন তামান্না

 

পাট এমন একটি পণ্য যার কিছুই ফেলে দেওয়া যায় না। সিনথেটিকের ব্যবহার পরিহার করে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জ্যামিতিক হারে বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়ছে। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় সোনালি ব্যাগ। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই যার চাহিদা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়াও পাট থেকে তৈরি হয় ভিসকস" সুতা। যা উৎপাদন করতে পারলে আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি পাট থেকে বস্তা, ফেব্রিক, হ্যান্ড ব্যাগ, কার্পেট, শাড়ি, পর্দা, জুতা, সোফা, শো-পিসসহ শত শত রকমের পণ্য তৈরি করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাতে পাটজাত এসব পণ্যের বিশেষ চাহিদা ও বৃহৎ বাজার রয়েছে। বর্তমানে পাট পাতা দিয়ে অর্গানিক চা তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। গুণগত মানসম্মত এই চা উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু করেছে জার্মানি। অন্যদিকে, পাটকাঠি পুড়িয়ে যে ছাই উৎপন্ন হয় তাতে আছে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন। সেটি দিয়ে তৈরি করা যায় ব্যাটারি, ঔষধ, প্রসাধনীসহ নানাবিধ সামগ্রী। ইতোমধ্যে পাটকাঠি পোড়ানো ছাই চীনে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়ছে, যা আইনত বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে ১০০ কোটি টাকার পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়বে দেশেই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে যে পরিমাণ পাট উৎপাদন করা হয়, তা ১০০ দিনে প্রকৃতি থেকে ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দান করে। যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো কঠিন সময়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এক আশীর্বাদ স্বরূপ।

ইউরোপের ২৮টি দেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ করে টেকসই, পরিবেশবান্ধব, সবুজ উন্নয়নের লক্ষ্যে পাটপণ্য ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেটা আমাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেও বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। আমাদের জিডিপির মাত্র ৩-৪ শতাংশ আসে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। এর অন্যতম কারণ ৮০-৯০ শতাংশ কাঁচা পাট আমরা রপ্তানি করি আর বাকি সামান্য সংখ্যক পাট আমরা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে পাটপণ্য তৈরিতে সক্ষম হই। অন্যদিকে রপ্তানিকৃত কাঁচা পাটের সিংহ ভাগই কিনে নেয় ভারত। সেসব কাঁচা পাট নিজেদের অত্যাধুনিক মেশিনে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করছে তারা। বিশ্ব বাজারের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে পাটপণ্য রপ্তানি করে অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুনাফা। পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের সমকক্ষ হলেও পাটজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার দখলের ক্ষেত্রে ভারত অনেক এগিয়ে।

‘সোনালি আঁশ’ অর্থাৎ পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মাটির গুণাগুণ ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পাট মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে বর্তমানেও পাটের উৎপাদন রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৪৫ লক্ষ কৃষকের সম্পৃক্ততায় দেশে প্রায় ৯০ লক্ষ বেল পাট আঁশ উৎপাদিত হচ্ছে, যা বিশ্বে মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। জাতীয় পাট নীতি-২০১৮ বাস্তবায়নে, সরকারের পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগ ও দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিই আমাদের মূল লক্ষ্য নয় বরং নিজেদের পাট পণ্যের ব্যবহারে সকলকে আগ্রহী হতে হবে। তাহলে দেশেই পাটের একটা বড় বাজার তৈরি হবে। সরকারি বেসরকারি পাটকলগুলোর পাশাপাশি পাটের বাজারে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।

পাটশিল্পের এই অপার সম্ভাবনার দিকে লক্ষ রেখে পরিপূর্ণ আধুনিকায়ন করে ক্রমানুসারে পাটকলগুলো খুলে দেওয়ার আশ্বাস দেন সরকার। গত ৯ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এক অধিবেশনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের কারণ ব্যাখ্যা করেন। এসময় তিনি বলেন, ‘বর্তমান পাট কারখানাগুলো সবচেয়ে পুরনো, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তৈরি। এগুলো দিয়ে শিল্পে লাভ করা সম্ভব নয়। পাটের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। সেজন্য আমরা চাচ্ছি এটাকে নতুনভাবে তৈরি করতে।’ লোকসান কমাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল যৌথ (পিপিপি) বা বেসরকারি অংশীদারিত্বে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন সরকার। বিগত প্রত্যেক বছরে সরকারি পাটকলগুলোতে সরকারকে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে, তার কিয়দংশ ব্যয় করে কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করা সম্ভব। কলগুলোর পুরনো সব যন্ত্রপাতি বদলে ফেলে সেখানে নতুন, উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের পরিকল্পনা সত্যিই অভিনব। তবে সেগুলো ব্যবহারের জন্য দক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে আমরা প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানি করে ৫/৬শ ডলার পাই, কিন্তু মিলগুলো আধুনিকায়ন করার পর সেখানে পাটের শাড়ি, ফেব্রিকস, কভার ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা যাবে। ফলে আমরা বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও জোগান দিতে সক্ষম হব। তবে সকল প্রচেষ্টার সফলতা পেতে হলে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা তথা দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বিজেএমসি, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দুর্নীতি দমন করতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যবস্থাপক সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সুনির্ধারিত দাম ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বৈশ্বিক বাজারে পণ্য সরবরাহ করবে।

 

শিক্ষার্থী : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।    

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads