• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

গুরুবিহীন সংগীত অভিযাত্রার আগামী সংকট

  • প্রকাশিত ১৬ অক্টোবর ২০২০

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম

 

 

সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা তা আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। শিক্ষা জীবনের শুরুতে যেমন অক্ষরজ্ঞান প্রয়োজন হয় এবং শিক্ষাগুরু আমাদের শিখিয়ে দেন, তা হতে পারে পরিবার কিংবা স্কুলশিক্ষক। তেমনিভাবে সংগীত শিক্ষার বিশেষায়িত অক্ষরজ্ঞান, যেমন সারেগামাপাধানি তেমনি কোনো না কোনো গুরুর হাত ধরে হাতেখড়ি নিতে হয়। বিশেষায়িত জ্ঞান বলে এ বিদ্যায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব কম। কেবলমাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিল্পী পরবর্তীতে আন্তরিকতার সঙ্গে সংগীতের দীর্ঘ সাধনা করে যান। বিভিন্ন বরেণ্য মানুষের সাহচর্যে তালিম গ্রহণ করে সুর, লয় এবং রাগরাগিণীর চলন ও তার প্রয়োগ বিধি রপ্ত করে যে সার্বিক শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওস্তাদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা প্রদানের মধ্য দিয়ে শিষ্য তৈরি করেন। এর বাইরেও সংগীত করা যায়, গায়েন হওয়া যায়, কিন্তু ওস্তাদ হওয়া খুব কঠিন কাজ। কেউ কেউ এমন অসাধ্যও সাধন করে ওস্তাদি করেন, কিন্তু সে সংখ্যা একাডেমিক আলোচনায় খুব বেশি টেনে আনার সুযোগ নেই।

আমরা সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে ইতোমধ্যে অনেকটা পথ হেঁটে ফেলেছি, এমন একটি প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে গুণী ওস্তাদ না হয় বাদই দিলাম, ওস্তাদ বলে সম্বোধন করার মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংগীতজ্ঞ আমাদের দেশে নেই। এই প্রসঙ্গটুকু প্রাসঙ্গিক করতে বোধকরি গবেষণার প্রয়োজন নেই, কারণ দিব্যচক্ষে এটি দৃশ্যমান হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতায় কোনো পরিবার থেকে সংগীতজ্ঞ তৈরি করার মনন আর চোখে পড়ে না। যদি কারণ উল্লেখ করতে চাই, হাজারটা কারণ সম্মুখে দাঁড়ায়। তবুও মোটাদাগে দু-একটি কারণ যদি খুঁজে দেখবার চেষ্টা করি, তাহলে সমাজে যেসব মানুষ আজ তথাকথিত সম্মানিত প্রভাবশালী, তাদের শতভাগ মানুষই এই অঙ্গের মানুষের বাইরে। যাদের দৃশ্যমান ভালো থাকা আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই, তাদের সবাই যেন এ অঙ্গের মূল্যবোধের মানুষ। একটি গ্রাম কিংবা একটি শহরের যে সংখ্যক মানুষকে মানুষ এখন সম্মানিত মানুষ হিসেবে সমীহ করেন, বর্তমানে তারা কেউই এই অঙ্গের মানুষ নয়। আমি যা বলতে চাইছি, এই সমাজের আমরা কেউই তাদের সম্মানের সেই উঁচু আসনে স্থাপিত করতে শিখিনি, ভক্তি তো দূরের কথা।

বরং উল্টোটা রপ্ত করতে শিখেছি বেশ ভালোই। একজন ওস্তাদের কথা বলি। গল্প শোনালেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে-পরে, ঠিক দশ বছর আগেও দু-চারজন ছাত্রকে পেয়েছেন, যাদের তালিম দিয়ে দিব্যি তার পরিবারটা চালাতে পারতেন কোনোমতে। বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তবতা হলো এমন, ঠিক বছর পনেরো আগে থেকে জনসংখ্যার অধিকাংশই খুব সচেতনভাবে, আর খুব সামান্য অংশ অবচেতনভাবেই সংস্কৃতির এই ধারাটা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসছে, এমনকি শুধু বেরিয়েই আসেনি, তারা রীতিমতো এটার বিপরীতে অংশগ্রহণ করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; যেন একটি নির্মোহ থেকে বেরিয়ে তারা খুব প্রশান্তি অনুভব করছে। কিন্তু সত্যি কি তাই? আর কেনই বা তা সত্য হবে না। ওস্তাদ বললেন, ‘শিষ্যের কোঠা শূন্যতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এতদিন যা করেছি ভয়ানক অন্যায় করেছি বলে মনে হচ্ছে সমাজের চোখে, নইলে গ্রামে বাস করা দুই হাজার মানুষের মধ্যে কুড়িজন সংস্কৃতি সচেতন মানুষ; অন্তত সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হতেই পারেন, যারা তাদের সন্তানদের আমার কাছে তালিম নিলে নিশ্চয়ই আমার না খেয়ে মরার উপক্রম হতে হতো না।’ জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলুন তো এমন হলো কেন? খুব সরাসরি বলে দিলেন, ‘সমাজে সম্মানের জায়গা তৈরি করার নাগরিক না থাকায় আমার হাত পেতে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় অনেকে খুশি হবেন বলে মনে হয়েছে। সে দেশে ওস্তাদ জন্মাবে কি করে? মানুষ কেনই বা তার সন্তানকে বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্ক করাতে যাবে বলুন তো? বরং দৃশ্যমান চিত্র যেখানে মানবিক পথের বিপরীতে চললে ঠকবাজ হওয়া যায়, সমাজে প্রতিপত্তিশীল হওয়া যায়, ক্ষমতার মালিক হওয়া যায়, সালাম পাওয়া যায় যত্রতত্র। বিলাসবহুল জীবনযাপন করা যায়, সমস্ত অপকর্মের হোতা হওয়া যায়, সমাজের একজন মানুষ আমার মানবিক তালিম দেওয়াটাকে কেনই বা পছন্দ করবেন? মুশকিলটা হলো, আগামী প্রজন্মের মানুষ গান করবে ঠিকই, কিন্তু সেটি হয়তো শুধু ওয়াজ মাহফিলে কিংবা কীর্তন করার প্রয়োজনে। যেখানে নির্মল মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করবে আনন্দ দিয়ে, বিনোদন দিয়ে মেধাকে একটি বিশ্বমানের মেধা হিসেবে তৈরি করবে, সেই জায়গাটাতে একটা অন্ধকার যুগের অমানিশা আমাদের স্বাগত জানাবে— সেটা খুব স্বাভাবিক। দেখুন, আধুনিক গান সৃষ্টি প্রায় হচ্ছে না বলেই চলে। ধ্রুপদী অঙ্গন থেকে আধুনিক গান বিলুপ্ত হলে শুধু ফোক গান প্রচলিত রেখে সংগীত এবং সুরের জগতের যে বিস্তার, ক্রমেই তা সংকুচিত হয়ে সংস্কৃতির একটা বড় অংশ অন্ধকারে মিশে যাবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

ওস্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন মানবিক মূল্যবোধের অভাবে জাতি এমন দশায় পতিত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?’ এক কথায় আমাকে বিস্মিত করলেন এই বলে যে, ‘যে জাতি জাতির পিতার সম্মানকে মুকুট হিসেবে ব্যবহার করতে শিখল না, সে জাতির এমন দশায় পরিণত হওয়ার বিষয়টি খুব স্বাভাবিক বাস্তবতা। আজ যদি বিষয়টি তা হতো, তাহলে আমাদেরও এই সমাজের মানুষ অনেক সম্মানিত মানুষ হিসেবে জানত, এমনকি সম্মানিত আসনে আসীন করতে শিখত আর আমাদের হয়তো কারো কাছে হাত পেতে চলার প্রয়োজন হতো না।’

সত্যিই এমন সম্পদ তৈরি করবার এবং বাঁচিয়ে রাখবার স্বার্থে জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার অনিবার্যতা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া রমনার বটমূল, সিনেমা হল, একুশে আগস্ট ট্র্যাজেডি, বিচারকদের চেম্বার কিংবা পোশাকের পুলিশ কেউই যেমন রক্ষা পায়নি, এখনো পাচ্ছে না, তেমনি করে সংস্কৃতির গোড়ায় এভাবে আঘাত অব্যাহত চলতে থাকলে এটি অপসংস্কৃতিতে ভরে উঠে প্রতিদিনই নতুন চটকদারি সংস্কৃতির মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। যার বর্তমান অবস্থার শিকার এই ওস্তাদজ! তেমনি করে এ পথে যারা অন্তত চিন্তা করতে শিখেছে, তাদের অবস্থাও একদিন এমনই হয়ে যাবে।

অশনিসংকেত হলো, ওস্তাদি বিদ্যার বাইরেও সংগীতে যে বিদ্যার প্রয়োগ হচ্ছে তা অতিমাত্রায় আশঙ্কার, যেমন বাণিজ্যিক, তেমনি মূল কাঠামোর সংস্কৃতি থেকে অনেকখানি বিচ্যুত। ফলে স্বেচ্ছাচারিতার ব্যবহার প্রকট হবে এবং নিজেদের মূল সংস্কৃতি বিলোপ হতে থাকবে। এখন একে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন এবং এ প্রয়োজনীয়তা এখনই অনুভব করার কোনো বিকল্প নেই। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন কোমল বুদ্ধিমান বিনয়ী সুনাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে এ বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং তাত্ত্বিক ও গবেষণাধর্মী বিদ্যার ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে। অন্যথায় জাতি, রাষ্ট্রের সম্মান যে গুণী মানুষগুলোর সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, তা এক সময় অনাহূত নাগরিকের পদতলে পিষ্ট হয়ে পুরো জাতিকেই দিকভ্রষ্ট করে ফেলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

লেখক : পুলিশ সুপার, গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads