• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০২০

ধানমন্ডি লেকের পাড় ঘেঁষে সাইকেল চালাতে চালাতে সে কী ভাবতো? লেকের শান্ত জলে হঠাৎ ঘাঁই মারা মাছের সঙ্গে সে কি আনমনে কথা বলতো? লেকের পাড়ের গাছগুলো কি তার বন্ধু ছিল? তাদের সঙ্গে কি সে মনের ভাব বিনিময় করতো? বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন রাসেল। জগৎখ্যাত দার্শনিকের নামে নাম। বাবার মুখে দার্শনিকের কথা শুনে সেও কি অমন জগৎখ্যাত কেউ হয়ে ওঠার কথা ভাবতো? একটি শিশুর ভাবনার জগৎ থাকে বিশাল, বিস্তৃত। শিশুর মনোজগৎ, ভাবনার জগৎ পরিপূর্ণ হতে থাকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎকে কেন্দ্র করে। পরিবারের সবার ছোট শিশু রাসেল ছিল সবার আদরের। সবার ভালোবাসার। সে ছিল বড় দুই বোনের চোখের মণি। অথচ সবার প্রিয়, সবার ভালোবাসার এই শিশুটিও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার সুযোগ পায়নি, তাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়নি বাংলার কিছু কুলাঙ্গার। তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি বাংলার ষড়যন্ত্রকারীরা।

যে বাড়ি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের হূদয়। সেই বাড়ির শিশুর প্রতি স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা বেশি। তাকে ঘিরে স্বপ্ন অনেক। তাকে ঘিরে রাখা ভালোবাসার মাঝে বেড়ে ওঠে সেই শিশু, তার চোখজুড়ে থাকা অপার বিস্ময়ের মাঝে বেড়ে উঠতে উঠতে সেও হয়ে উঠবে ভুবনবিখ্যাত, জগৎখ্যাত। সে আশাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালির সেই আশাকে পূর্ণ হতে দেওয়া হয়নি। সেই শিশুকে তার স্বপ্ন পূরণ করতে দেওয়া হয়নি। সেই শিশুকে স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়নি খুনি ঘাতকের দল। সেই শিশুকে বঞ্চিত করা হয়েছে বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে, বঞ্চিত করা হয়েছে বোনের ভালোবাসা থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্কিত দিন। বাঙালির সব হারানোর দিন। বাঙালির পিতা হারানোর দিন। বাঙালির জীবনে শোকাবহ এই দিনে খুনি ঘাতকের দল নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। খুনি ঘাতকের দল এদিন জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা একে একে হত্যা করে জাতির পিতার পরিবারের সব সদস্যকে। তাদের নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি শিশু রাসেলও। খুনি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট কেড়ে নিয়েছে শিশু রাসেলের প্রাণ। যে শিশুর জগৎ ছিল শান্ত লেকের পানি, মাছ, প্রকৃতি নিয়ে; যে শিশু বেড়ে উঠছিল বাবা-মায়ের পরম মমতায়; বড় ভাইবোনের ভালোবাসায়— সেই শিশুর শরীরে বুলেটের আঘাত করতে কাঁপেনি ঘাতকের হাত। যে কোনো শিশুর প্রতিই মানুষের থাকে সহজাত ভালোবাসা। যে কোনো শিশুই তার স্বাভাবিক সারল্য দিয়ে মানুষের মন জয় করে নেয়। কিন্তু শিশুর রাসেলর কচি প্রাণ-মন গলাতে পারেনি ঘাতকের নৃশংসতাকে। ঘাতকের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানতে হয়েছে শিশু রাসেলকে।

ইতিহাসের ঘৃণিত খুনিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যখন বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের একে একে হত্যা করছিল, ঘাতকদের সেদিনের সেই নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আবদুর রহমান শেখ ওরফে রমা। ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই তাদের জঘন্যতা শেষ করেনি। বরং বাংলাদেশের মাটিতে যেন খুনিদের বিচার না হয়, সে ব্যবস্থাও করে। হত্যাকারীদের বিচার যেন না হয় সেজন্য জারি করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হিসেবে কুখ্যাত সেই অধ্যাদেশের বদৌলতে দীর্ঘকাল খুনিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা লাভবান হয়েছে, যারা বাংলাদেশকে আবার পিছিয়ে দিতে চেয়েছে, যাদের কাঁধে ভর করেছে পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো নানাভাবে খুনিদের সহায়তা করে। তাদেরকে বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাস, হাইকমিশনে উচ্চপদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করে। জাতিকে সেই কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেয় জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার। জনগণের ভোটে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর জাতিকে মুক্তি দেয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের অভিশাপ থেকে। বাতিল করা হয় এই অধ্যাদেশ। খুনিদের বিচারের পথ সুগম হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পায়। আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সে সময়ের বিশ্বস্ত গৃহকর্মী আবদুর রহমান শেখ (রমা) জবানবন্দিতে বলেন, “আমি ১৯৬৯ সালে কাজের লোক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৫টায় বঙ্গবন্ধু নিহত হন। তখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থাকতাম। ওই দিন, অর্থাৎ ঘটনার দিন রাতে আমি এবং সেলিম দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলাম। আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। ওইদিন তিনতলায় শেখ কামাল এবং তার স্ত্রী সুলতানা ঘুমিয়েছিল। ওইদিন শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী এবং ভাই শেখ নাসের দোতলায় ঘুমিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী এবং শেখ রাসেল দোতলায় একই রুমে ঘুমিয়েছিল। নিচতলায় পিএ মহিতুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মচারী ছিল।

আর্মিরা নাসের, রাসেল ও আমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেখানে সাদা পোশাকের একজন পুলিশের লাশ দেখি। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’ তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই গুলির শব্দ ও তার মাগো বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাই। শেখ রাসেল ‘মার কাছে যাব’ বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছিল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ এমন সময় একজন আর্মি তাকে বলল, ‘চলো তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।’ এই বলে তাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে পাই।”

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘাতকেরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে আরো একটি স্বপ্নকে। ঘৃণিত খুনিরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ যেন কোনোদিন বেরিয়ে আসতে না পারে, বাঙালি যেন স্বাধীন দেশের স্থপতির হাত ধরে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য আমাদেরকে অভিভাবকহারা করেছিল। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, তার সেই চাওয়া যেন পূরণ না হয়, বাঙালি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তাই ঘাতকের দল হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু  শিশু রাসেলের কী অপরাধ ছিল?

১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে পরিবারের মুখ আলো করে জন্ম নেওয়া শিশুর কী অপরাধ ছিল, কেন তাকে হত্যা করা হলো, তা কি শুধু ভয় থেকে? যেন ভবিষ্যতে শিশুটি জাতিকে নেতৃত্ব দিতে না পারে! ঘৃণিত খুনি শিশু রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুছে দিতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার। কিন্তু তাদের সে সাধ পূরণ হয়নি। বাঙালির মনে শেখ রাসেল বেঁচে আছেন। তিনি বাঙালির মনে চিরদিন ইতিহাসের এক স্বপ্নবান শিশু হয়েই বেঁচে থাকবেন।

শুভ জন্মদিন, শহীদ শেখ রাসেল।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads