• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ

  • প্রকাশিত ২২ অক্টোবর ২০২০

মো. জাফর আলী

 

 

শিক্ষার আলো ছাত্রসমাজকে নীতি-নৈতিকতা, সত্য, ন্যায় ও ন্যায্যতার পথ দেখায়। মূলত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ন্যায়ের পথে চালিত করে সব প্রকার অন্যায় থেকে দূরে রেখে, মানুষের মতো মানুষ তৈরি করা। এজন্যই হয়তো সমাজে যেকোনো সমস্যা বা বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা সমাধানে সর্বপ্রথম ছাত্র বা শিক্ষিত সমাজকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এই ছাত্রসমাজের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সাধারণত বয়স, বিবেক ও জ্ঞান অর্জনের পরিপক্কতার কারণে ভালো-মন্দ চিহ্নিত ও অনুধাবন করার ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি থাকে। এজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবসময় দেশের যেকোনো ধরনের অনিয়ম, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা এবং সমস্যা সমাধানের কথা বলে এবং সময়ের প্রয়োজনে রাজপথে নেমে আসতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

বিশেষ করে, এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪’র আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬৬-তে ৬ দফা, ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য জাতীয় কার্যক্রম, আন্দোলন ও প্রতিবাদের মাধ্যমে নিজেদের জীবনবাজি রেখে, মানুষের অধিকার আদায়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, সাধারণত অন্যান্য দেশ তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত হয়েছে।

পূর্ব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের পর থেকে বর্তমানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যার যার অবস্থান থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলছে। এজন্য তারা অনেক সময় বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেও প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে হয়রানি, সন্ত্রাসী হামলা, এমনকি মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, এরকম ধারণার বশবর্তী হয়েও গ্রাম পর্যায়ে প্রতিহিংসাজনিত কারণে সরাসরি মিথ্যা মামলা করাসহ, মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ার নষ্ট করার ঘৃণ্য পাঁয়তারা বিভিন্ন জায়গায় চলছে। ঢাবি শিক্ষার্থীদের সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটা এমন অনেক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে অধিকাংশ সময়ে ভিকটিমের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে এ ধরনের ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এরকম শত শত হামলা-মামলার মাঝেই চলতি বছরের ১৮ জুন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে তুচ্ছ একটি বিষয়কে (আম পাড়া) কেন্দ্র করে এক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র মেহেদি মোস্তফা (২০০৬-০৭ সেশন)। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেককে ব্যথিত করে।

এরই প্রেক্ষিতে ঢাবি ছাত্র, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাবেক জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার ঢাবি শিক্ষার্থীদের আইনি ও পুলিশি সহায়তাসহ সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একটি অনলাইন প্লাটফরম তৈরি করার পরিকল্পনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন। আর তৎক্ষণাৎ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সিনিয়র এএসপি মোঃ জুয়েল রানা ও মেহেদী শামীমসহ ঢাবির সাবেক-বর্তমান অনেকেই এগিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও জুলিয়াস সিজারের উদ্যোগে ‘সবাই মিলে গড়ি নিরাপদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’ সংগঠনটির। এর কার্যক্রম মূলত একটি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই গ্রুপটি মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বর্তমানে ২১ হাজার সদস্যের বৃহৎ একটি পরিবার এবং দিন দিন এর পরিধি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সমস্যায় জর্জরিত যেকোনো ঢাবিয়ান তার সমস্যার কথা গ্রুপটিতে পোস্ট করলে বা পেজে মেসেজ দিলে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকগণ সঙ্গে সঙ্গে আইনি ও প্রশাসনিকসহ যেকোনো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। আর এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলোর অপরাধীকে এ সংগঠনের প্রচেষ্টায় ১০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। মূলত চারটি টিম দিয়ে সংগঠনটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এগুলো হলো—সাইবার সিকিউরিটি টিম, আইন সহায়তা টিম, প্রশাসনিক সহায়তা টিম ও নারী নিরাপত্তা টিম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এই সংগঠনে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি অনেক বিচারক ও অ্যাডভোকেটসহ বহু পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছেন। যার কারণে খুব সহজেই ও দ্রুত বিভিন্ন সমস্যার উপযুক্ত সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই কয়েক মাসেই প্রায় শ’খানেক সমস্যার সমাধান করেছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ। ছাত্রীদেরকে উত্ত্যক্তকারী, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী, অনলাইন প্রতারক ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, আর্থিকভাবে অসচ্ছল ঢাবি শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারকে আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, বিনামূল্যে রক্ত ও প্লাজমা সংগ্রহ, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাপ্রবণতা ঠেকানো, টিউশন ঠিক করিয়ে দেওয়া ও শিক্ষাগত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানসহ বহু কল্যাণমূলক কাজই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’-এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শততম বর্ষ উপলক্ষে শিক্ষামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০০ জন শিক্ষার্থীকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সংগঠনটি। এর মধ্যে ১০০ জনকে গ্রাফিক্স ডিজাইন ও বাকি ১০০ জনকে ফ্রিল্যান্স রাইটিং স্কিল শেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

এভাবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে, দেশব্যাপী অন্যায়-অনাচার এবং মানুষের অধিকার আদায়ে সব ধরনের কল্যাণমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সংগঠনটি বদ্ধপরিকর। দেশ ও জাতির স্বার্থসম্পর্কিত ঐতিহাসিক সব কার্যক্রম, ঘটনা ও আন্দোলনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার সংগ্রামে এই সংগঠনটি সবসময় লিপ্ত থাকবে, এটাই প্রত্যাশা। সর্বোপরি সংগঠনটির অগ্রযাত্রাকে সর্বোচ্চ সমর্থন জানিয়ে বলতে চাই, শুভকামনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads