• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কিশোর অপরাধ এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

  • প্রকাশিত ২৫ অক্টোবর ২০২০

হাসনা হেনা

 

 

 

বর্তমানে আমাদের সমাজ তথা দেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কিশোর অপরাধ। বিভিন্ন কারণে আমাদের সমাজের  কিছু কিশোর অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে, দলবদ্ধ হয়ে গ্যাং তৈরি করে ওরা হয়ে উঠছে সমাজের ত্রাস। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এক সময় নগরকেন্দ্রিক থাকলেও এখন কম-বেশি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। দিন দিন কিশোর অপরাধ যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি বয়সি ছেলেদের কিশোর গ্যাং নামক গ্রুপগুলো।

বিশ্বকবি বলেছেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই।’ কথাটা একদমই সত্য। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের আবেগ, চিন্তা, চেতনা ও চলাফেরায় পরিবর্তন আসে। বিগত দিনগুলোতে চলে আসা শাসন-বারণকে তারা আর মানতে চায় না। কিশোর-কিশোরীরা তাদের নিজের মতামত বা ভাবনাকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চায়। কিশোর বয়সের এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় পরিবার, সমাজ আর তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা। অনেক সময় অতি দারিদ্র্য কিংবা অতি প্রাচুর্য কিশোরদের বিপথগামী করে।

বর্তমান সময়ের অতি আলোচিত গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত কিশোররা ভয়াবহ ধ্বংসের পথে হাঁটছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবার সামাজ তথা দেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয় এটি। আধিপত্য বিস্তারের হীন মানসিকতা থেকে ওদের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে হিংসা, ক্রোধ আর দ্বন্দ্ব। ওরা জড়িয়ে যাচ্ছে চুরি, মাদক, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ খুন-খারাবির মতো জঘন্য সব অপরাধের সঙ্গে। এমনকি, মাদক পাচার, অবৈধ্য অস্ত্র বহনের মতো মারাত্মক অপরাধের কাজে উঠতি বয়সের কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার খবর শোনা যাচ্ছে। ইদানীং প্রায়ই পত্রিকার পাতায় আমাদের চোখে পড়ছে কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ংকর সব চিত্র। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয় এসব গ্যাং ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিভিন্ন জেলা শহরের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক নানারকম অপরাধমূলক কর্মকা্লে। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর গ্যাং কিংবা কিশোর অপরাধ নিয়ে আমাদের ভাববার সময় এখনই, এই সমাজে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের সমাজ তথা দেশের মূল্যবান এক অংশ হচ্ছে তরুণ। যে তারুণ্যের চোখে স্বপ্নবুনে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাবো, সে তরুণরাই কেন আমাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে? একজন বিপথগামী তরুণ একটি পরিবারকে তছনছ করে দেয়ার জন্যই যথেষ্ট। তেমনি কয়েকজন বিপথগামী তরুণ পুরো সমাজকে নষ্ট করে দিতে পারে।

দেশে কিশোর অপরাধ কতোটা বাড়ছে, পুলিশের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান দেখলেই খুব সহজেই বোঝা যাবে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১২ সালে কিশোর অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে মামলা রেকর্ড হয়েছে ৪৮৪টি। মামলায় আসামির সংখ্যা ৭৫১ জন। ২০১৩ সালে কিশোর অপরাধের ৫৮৯ মামলায় আসামি ৮৪৮ জন। ২০১৪ সালে মামলা হয়েছে ৮১৮টি, আসামির সংখ্যা এক হাজার ২৬৩। ২০১৫ সালে এক হাজার ১৮৪টি। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৯৬টি। এ হিসাবে এক বছরে কিশোর অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের বেশি। আর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে।

২০১৭ সালে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সকলকে হতবাক করে দেয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুন হলে। রাজধানীর উত্তরায় বখাটে কিশোরদের ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘নাইনস্টার’, ‘বিগবস’ প্রভৃতি নামের গ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিণামে আদনান কবির খুন হয়। বেপরোয়া এসব গ্রুপের কিশোররা ‘নাইন স্টার’ গ্যাংয়ের আদনানকে হত্যার আগে অস্ত্র হাতে সেলফি দিয়েছিল। তার আগেও দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছিল। আদনান হত্যায় জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও গ্যাংগুলো থেমে থাকেনি। এক জরিপ থেকে জানা গেছে, কিশোর অপরাধীদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুন করে তার ছেলে রবিন বড়ুয়া।

একজন মানুষের জীবনগড়ার সর্বোৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে তার কৈশোর। সুশিক্ষা, চরিত্র, বিনয়, অধ্যাবসায়, নীতি, আদর্শের ভীত তৈরি হয় কিশোর বয়স থেকেই। তরুণরাই নতুন স্বপ্নের সূর্য— সমাজ ও দেশের আগামীর সম্ভাবনা। ওরা বিপথগামী হলে সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোরদের মধ্য অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং বা হিরোইজম ভাব বেশি দেখা যায়। কিশোরদের বেড়ে ওঠার পরিবেশই তাকে অপরাধী করে গড়ে তোলে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, কিশোর অপরাধের মূল ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার ও সামাজ। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে— প্রতিটি শিশু ও কিশোর পরিবার ও সমাজ থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ যত্নের দাবি রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবার ও সমাজ থেকে নানা কারণে শিশু-কিশোররা সঠিক তদারকি ও যত্ম পায় না। এর বিরূপ প্রভাবে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়ে অনেক শিশু-কিশোর সুশিক্ষার  পথ থেকে ছিটকে যায়। ছোট ছোট ভুল করতে করতে একসময় বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তারা।

শিশু-কিশোরের নৈতিক শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান। মা-বাবা নৈতিকতা মেনে চললে এবং নিজ সন্তানদের শিক্ষা দিলে শিশু-কিশোররা তা অনুকরণ করে মেনে চলতে শিখবে। পরিবার থেকে চরিত্র গঠনের নৈতিক গুণাবলি অর্জন করতে পারলে কিশোর অপরাধপ্রবণতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হবে। সন্তানদের সঠিক প্রতিপালনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে ইসলাম। এ প্রসঙ্গে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘পিতার ওপর পুত্রের যে অধিকার আছে, পুত্রের ওপরও পিতার তদ্রূপ অধিকার আছে। পিতার অধিকার হলো, পুত্র শুধু আল্লাহকে অমান্য করার আদেশ বাদে তার সব আদেশ মেনে চলবে এবং পুত্রের অধিকার হলো, পিতা তার একটি সুন্দর নাম রাখবে, তাকে উত্তম প্রশিক্ষণ দেবে এবং কোরআন শিক্ষা দেবে।’ ইসলাম অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে বলেছে। এ কারণে সন্তানদের নৈতিক সুরক্ষার্থে ধর্মীয় বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালিত করার কোনো বিকল্প নেই। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত চরিত্র গঠনের উত্তম গুণাবলি, যেমন— তাকওয়া, শালীনতা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, আমানতদারিতা, সবর, ইহসান, বিনয়, নম্রতা, উদারতা, দানশীলতা প্রভৃতি গুণাবলি পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানকে শিক্ষা দানের চেষ্টা করতে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মা-বাবাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে তাদের সন্তান কেমন বন্ধুদের সঙ্গ নিচ্ছে। উঠতি বয়সি ছেলে-মেয়েরা বন্ধুদের অনুকরণ করে বেশি। সঙ্গদোষে অনেক সময় কিশোররা অন্যায়ের পথে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হচ্ছে, আমরা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ভিনদেশি সংস্কৃতির সহজলভ্যতায় আমাদের তরুণসমাজের কাঁধে ভর করেছে অপসংস্কৃতি। আর এর প্রবাবসহ একশ্রেণির স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরাও গ্যাং কালচারে জড়িত সংঘবদ্ধ উঠতি বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অর্থের বিনিময়ে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

এছাড়াও পারিবারিক-সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে হতাশ কিশোর-তরুণরা মাদকাসক্ত ও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মা-বাবার বিচ্ছেদ, পরিবারে অশান্তি শিশু-কিশোরদের মনে যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে, সেই হতাশাও তাদেরকে বিপথগামী করছে। আর তাই পিতা-মাতাসহ পরিবারের সব সদস্যের এবং সমাজকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু আইনি ব্যবস্থায় এর প্রতিকার সম্ভব নয়। কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখতে এসব অপরাধের শেকড়ের সন্ধান করতে হবে। শেকড়সহ উপড়ে না ফেললে এর প্রতিকার হবে না। সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে কেবল শিশু-সমাজকে উন্নত করলেই চলবে না, পুরো সমাজের উন্নয়ন প্রয়োজন। কিশোরদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে হবে। ওদের খেলাধুলার স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে হবে। বই পড়ায় উৎসাহিত করতে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক পাঠাগার নির্মাণ করতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থাও কিশোর অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ। সামাজিক ভাবে সকলে মিলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে কিশোরদেরকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা অন্যের সন্তান বিপথগামী হতে দেখলে মনে মনে এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, আমার নিজের সন্তান তো অপরাধী হয়নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অপরাধ আসলে ছোঁয়াচে রোগের মতো, ক্রমেই পুরো সমাজে ছড়িয় পড়ে। যে সমাজে আমি বাস করি, সে সমাজটি কিন্তু আমারই। সমাজের প্রতিটি মানুষকে তাই আপন ভাবতে হবে। নিজের ভাবনার জায়গাটা আরো বড় করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন আমাদের মানবিক মনোভাবসম্পন্ন হয়ে ওঠা। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে অন্যায় দেখলেই প্রতিরোধের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক সহমর্মিতা, কর্তব্যপরায়ণতা আর সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।

 

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads