• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বগতি

দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে

  • প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর ২০২০

মো. ফুয়াদ হাসান

 

 

 

২০১৯ সালের শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান অঞ্চল থেকে শুরু হওয়া প্রাণনাশক করোনাভাইরাসের প্রভাবে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। পরিবর্তন হয়েছে পৃথিবীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব পরিমণ্ডলে। বিজ্ঞানের চরম সাফল্যের (গৃহ থেকে মহাকাশ) অতীব সহজ, আধুনিক আর বিলাসবহুল পৃথিবী যেন নিমিষেই নিস্তব্ধ করে দিয়েছে ছোট্ট একটি শব্দ কোভিড-১৯। এর ফলে অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো আজ বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে পৃথিবীর দেশগুলোর। খাদ্য ও তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা আমাদের বাধ্য করছে অসহায়ত্ব বরণ করতে। করোনার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আয় কমছে বহু মানুষের। আইএলও’র ভাষ্যমতে, করোনার প্রভাবে পৃথিবীতে নতুন ৩৩০ কোটি মানুষ কর্মহীন হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। যদিও আইএলও’র মতে, দেশে কর্মক্ষম প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ কর্মহীন। করোনার প্রভাবে বেকারত্বের ও নিম্নআয়ের মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে করোনায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় খাদ্য মজুত ও আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। বিশ্ববাজার থেকে সবচেয়ে বেশি গম ক্রয় করে মিসর। এপ্রিলের পর থেকে মিসর গম আমদানি বাড়িয়েছে ৫০ ভাগ। গম আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক তুলে নিয়েছে মরক্কো। অন্যদিকে রেকর্ড পরিমাণ গমের মজুত গড়ে তুলেছে জর্ডান। আর গমের পাশাপাশি চিনি ক্রয় বাড়িয়েছে পাকিস্তান। তাইওয়ান জানিয়েছে খাদ্য মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য আমদানি কার্যক্রম গতিশীল করেছে বিশ্বের জনবহুল দেশ চীন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি চাহিদা বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের মূল্যসূচকও এখন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বরেও টানা চতুর্থ মাসের মতো ঊর্ধ্বমুখিতায় ছিল বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক। ওই সময় বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২ শতাংশেরও বেশি।

করোনা সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় বিশ্ব অর্থনীতি যখন শ্বাস নিতে পারছে না, দেশে দেশে যখন বিভন্ন সূচকের নিম্নগতি চলমান, ঠিক এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রশান্তি রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি। এপ্রিলের শুরুতে বিশ্বব্যাংক শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, কোভিড-১৯-এর  প্রভাবে এ বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ২২ শতাংশ কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নামতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্থাটির হালনাগাদ তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানিছে, মহামারীর কারণে বেশিরভাগ দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নামলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। এটা আরো বেড়ে ২০২০ সালে প্রবাসী আয়ে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২০ সালে ৮ শতাংশ বেড়ে বাংলাদেশে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে। এদিকে বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদন বলছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রায় সবকটি দেশেই রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক ছিল। এই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে ভারত, শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়ারও। তবে এ পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। শুধু তা-ই নয়, পরের প্রান্তিকে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধিও পেয়েছে দেশ তিনটি। রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টেও ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় লাইফ লাইনের মতো কাজ করে। দেশের মোট জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ফলে বর্তমানে ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বর্তমানে ১৭৪টি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ। ১৯৯৩ সালে এই সংখ্যা ২ লাখ অতিক্রম করে। ২০১৭ সালে রেকর্ড সংখ্যক প্রবাসী বিদেশে পারি জমায় যার সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬-৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে যায়।

প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ বিদেশে যায়। এসব প্রবাসী বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। স্থানীয় মুদ্রায় যা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি। করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের ধাবমান গতির কিছু কারণ দেখিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে— এক. মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশের মুসলিম প্রবাসীরা হজের জন্য টাকা জমিয়ে রাখেন। কিন্তু মহামারীর কারণে এবার হজ বন্ধ থাকায় তারা সেই টাকা দেশে পাঠিয়েছেন; দুই, দেশব্যাপী হওয়া দীর্ঘমেয়াদি বন্যাকেও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বন্যায় প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ও ৪৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রবাসী স্বজনরা বেশি টাকা পাঠিয়েছেন; তিন, মহামারীর মধ্যে এপ্রিল-জুন সময়ে লকডাউনের কারণে অর্থ জমে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনানুষ্ঠানিক (হাতে হাতে বহন) থেকে আনুষ্ঠানিক বৈধ পথে (ব্যাংকের মাধ্যমে) অর্থ আসায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি হয়েছে; এবং চার, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার যে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, এটিকেও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। করোনার মহামারীর মাঝেই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স-যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর ভর করে দেশের অর্থ ব্যবস্থা সচল হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত তাদের ভালো রাখার ব্যবস্থা করা।

কিন্তু আসলে আমরা কতটুকু নির্বিঘ্ন করতে পেরেছি তাদের প্রবাস জীবন। বাংলাদেশের সিংহভাগ শ্রমিক অদক্ষ বা অশিক্ষিত ফলে তাদের নিম্ন মানের কাজ দেয়া হয়। সেসব কাজের ঝুঁকি বেশি, কিন্তু বেতন অপর্যাপ্ত। তাদের ভোগান্তির শুরু হয় ঘর থেকে। আমাদের রেমিটেন্স-যোদ্ধাদের অধিকাংশই গ্রামের অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ। দালালরা প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা গোপন করে, উচ্চ বেতন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাজের জায়গা, রাজকীয় জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশ পাঠানোর ফাঁদে ফেলে। তারপর  পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ডাক্তারি পরীক্ষা, ভিসা, ইমিগ্রেশন, স্মার্টকার্ড এবং বিমান ভাড়া ইত্যাদির  কথা বলে সূক্ষ্মভাবে হাতিয়ে নেয় প্রয়োজনের দ্বিগুন টাকা। সহজ-সরল এই মানুষগুলো প্রবাসে গিয়ে পড়ে দুর্বিপাকে। যারা মহামারীর দুর্দিনে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে, ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমাদের এখনই কাজ করতে হবে। মানবপাচারকারীদের দমন করতে হবে, দালাল বা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের নির্মূলে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, সর্বোপরি দেশের শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। পাশাপশি আভিবাসন ব্যয় কমাতে হবে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যয়ের বিষয়টা সুনির্ধারিত হতে হবে। প্রবাসে তাদের ভোগান্তি দূর করার লক্ষ্যে সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। দূতাবাসগুলোকে স্বদেশী মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারকে শ্রমবাজার বৃদ্ধির লক্ষ্য আরো নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের স্বদেশী পরিবেশে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। 

এদিকে গত ২২ অক্টোবর প্রকাশিত বাংলাদেশে ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে) আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৩২৫ কোটি ২০ ডলারের পণ্য।  প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার ৬৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। মহামারির আগে প্রতি মাসে পণ্য আমদানিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হলেও, এখন তা তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ফলে বিনিয়োগ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ডলার আসছে, তবু শিল্পায়ন হচ্ছে না। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনুৎপাদনীয় খাতে ব্যয় না করে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষ ব্যবহারের পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads