• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সময়টা স্বল্প নিয়ে বাঁচার

  • প্রকাশিত ০২ জানুয়ারি ২০২১

নাজমুল হাসান

 

 

 

মানবসভ্যতার প্রাথমিক কালে ‘উপনিষদ’-এ অমৃতের পুত্র হওয়ার অধিকারী মানুষ নিয়ে, সভ্যতার প্রাণপ্রাচুর্যতা নিয়ে, আনন্দপূর্ণ জীবন নিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল : ‘এই পৃথিবী সকল জীবের নিকট মধুস্বরূপ। এই পৃথিবীতে সকল জীব মধু। বাতাসে মধু বয়, নদীর জলে মধু ক্ষরে। ঔষধিরা মধুময় হোক। দিবা এবং ঊষা মধুময় হোক।’ ‘উপনিষদ’-এর এই আনন্দ, মধুরসপ্লাবিত দর্শনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন শোপেনহাওয়ার, ডয়সন, ম্যাক্সমুলার, রবীন্দ্রনাথের তুল্য মনীষীরা। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র যে বাণী পাশ্চাত্যকেও বিমোহিত করেছিল, সেখানেও দেখা মেলে এই ‘আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ’। ঔপনিষদিক দর্শনের সারবস্তু : ‘সকল আকাশ সকল ধরা/ আনন্দ হাসিতে ভরা,/ যেদিক পানে নয়ন মেলি/ ভালো সবি ভালো।’ বুঝতে পারি সেই শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা : সেটিও ছিল এমন আনন্দ, প্রাণ, ‘সবি ভালো’-পূর্ণ। যে সামষ্টিক ব্যবস্থায় সকলের সমান অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা ছিল। অনুপস্থিত ছিল কোনো অধীনতা, শোষণ ও অত্যাচার। এই ব্যবস্থার পর ধারাবাহিকভাবে এলো দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং পুঁজিতন্ত্র। সমাজ বিকাশের এসকল স্তর যুগে যুগে পৃথিবীর, মানবসভ্যতার খোলনলচে বদলে দিয়েছে। সৃষ্টি করেছে নব নব বাস্তবতা। আর মানুষকে করেছে স্বার্থের ঘেরাটোপে বন্দি। আজ একুশ শতকের দুই দশক অতিক্রম করে আমরা বাস করছি এক অমানবিক পৃথিবীতে। বৈষম্যই যেখানে নিরঙ্কুশ সত্য। আমাদের অবিদিত নয়— করপোরেট যুগ ক্রমাগত মানুষের মধ্যে অন্তহীন চাহিদা তৈরি করে চলেছে। এর নিত্যনতুন লাঠি-লজেঞ্চুস, পণ্য-কারসাজি, ভোগের-ভেল্কিবাজি দেখে মানুষ নিজেদের সামলাতে পারছে না। ছুটে চলেছে অন্তহীন চাইয়ের পেছনে, টাকার পেছনে। নিজেকে ছাড়া আর কোনোদিকে তাকানোর অবকাশ নেই তার। চাই, চাই, আরো চাই। এই স্বর ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়েই। মানুষের ‘হা’ প্রসারিত হয়েই চলেছে দিনের পর দিন। কল্পিত দৈত্য-দানব নয়, এক মানুষ গিলে ফেলতে চাইছে সমস্ত পৃথিবীকে। আর এই ছোটার পাল্লায় টিকতে গিয়ে সে পৃথিবীটাকে করে তুলছে বাসের অযোগ্য।

এই যে মহামারী, এটিও তো তারই ফল। সার্বক্ষণিক নিজের কথা ভাবতে গিয়ে মানুষ এটা ভুলে যাচ্ছে যে, সামাজিক জীব হিসেবে তাকে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। সবাইকে নিয়েই তার বাঁচার কথা। প্রকৃতির সকল প্রাণকে ভোগের কাঙ্ক্ষায় ডাইনিংটেবিলে নিয়ে আসার কথা নয়। মানুষের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বিদ্যাসাগর তার সমকালে এমন কোনো চরিত্রবান মানুষ পাননি— যার কপাল তিনি নিজের চটি দিয়ে ঠুকে দিতে পারেন না। শত বছরের ব্যবধানে আজ সবই অধিকতর নিম্নগামী। সম্ভবত আজকের দিনে এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না— যাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কেউ কমে, কেই বেশিতে। তবে বিকোচ্ছে সবাই। আলু, পটোল, লবণের মতো। যা ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কে প্রশ্নের পর প্রশ্নের জন্ম দেয়— এত টাকা কী করে মানুষ? কত টাকা চাই তার? কত অর্থের, কত সম্পদের মালিক হলে বন্ধ হবে তার এই দানবিক ‘হা’? এর কোনো সরল উত্তর অনুপস্থিত থাকলেও, প্রতিনিয়ত খবর আসে— ‘মানুষ’ নামেরই কেউ বিশ্বের সবথেকে ব্যয়বহুল আয়োজনে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। কেউ তৈরি করছেন পৃথিবীর সবথেকে বিলাসবহুল বাসগৃহ, প্রমোদের জন্য হারেম। কেউ রুগ্ণ রাষ্ট্রের সরকারগুলোর কাছ থেকে কিনছেন বড় বড় সরকারি কোম্পানি। কেউবা কিনছেন আস্ত দ্বীপ, ভূখণ্ড, জনপদ। এমনকি চাঁদের দেশে প্লট। আরেকটি কারণও রয়েছে, সেটি নিরাপত্তার। আজকের দিনে টাকাটাই সব থেকে বড় নিরাপত্তারক্ষী। এই বোধটা কাজ করে যে— টাকা থাকলেই সে ভালোভাবে থাকতে পারেবে, বিলাসী জীবনযাপন করতে পারবে। এমনকি ভালো চিকিৎসাটাও কিনতে পারবে। তবে চলমান মহামারী কি টাকার নিরাপত্তারক্ষী চরিত্রকেও নাজুক করে ছাড়ল না? মহামারী যখন সমস্ত ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মানুষকে গুহায় ঢুকিয়ে ফেলল, তখন দেখা গেল প্রাণ বেচা-কেনার দোকানেও কপাট পড়ে গেল। টাকা থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের হাসপাতালগুলো যথার্থ চিকিৎসা দিতে পারল না। তবু টাকা মায়া-বিষটা মানুষের মাথা থেকে অপসৃত হলো না। মহামারী নিয়ে বহু প্রতারণা ও লুটের ফাঁদে আমরা টাকার অশেষ মাজেজাটা দেখলাম। একবারে চোখ ছানাবড়া করে। হতাশ না হয়ে উপায় কই!

 

দুই

পুরনো দিনে সভ্যতার অগ্রযাত্রাকেই মানুষের অগ্রযাত্রা বলে বিবেচনা হতো, মানুষের ইতিহাসও রচিত হয়েছে সে দৃষ্টিভঙ্গিতেই। সেই ঊষালগ্নের মানুষদের অভিহিত করা হয়েছে অসভ্য, বর্বর। কিছু অর্থে পশুর তুল্য বলে। আজকের মতো সামাজিকতা, আচার, ব্যবস্থা অনুসরণের কোনো বালাই তাদের ছিল না। পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ এমন ধারণা সার্বিক অর্থে পরিবর্তন করে দিয়েছে। ফলে সভ্যতা এবং মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাস পরিগ্রহ করছে ভিন্ন পথ। মানুষের অগ্রযাত্রা এখন নিহিত তার মানবিক বোধে, সহিষ্ণুতার শিক্ষায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এবং মানুষে মানুষে, সাদায়-কালোয় ভেদজ্ঞান লোপের মধ্যে। কিন্তু মানুষ এই প্রত্যাশিত সুস্থ পথে অগ্রসর হয়নি। একুশ শতকের দুই দশক পেরিয়েও টিকে রয়েছে বহু প্রশ্ন। হতাশার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি অসাম্য, অনাহার, দারিদ্র্য ও যুদ্ধের আশঙ্কা। সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক মনমোহন মিত্র তিন দশক পর জন্মশহর কলকাতায় ফিরে মানুষকে পশুর মতো রিকশা টানতে দেখে প্রশ্ন করেছিল— ‘এরই নাম কি সভ্যতা’? তেমনি আমরাও এমন বৈশ্বিক বাস্তবতায় প্রশ্ন করতে পারি— এরই নাম কি মানুষের অগ্রযাত্রা? এর উত্তর খুঁজতে গেলে হতাশার কারণ থেকে যায় বৈকি! মানুষ এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার যে নেতিবাচক চিত্র দেখছি— এর জন্য আদতে দায়ী কে? কোনো তাত্ত্বিক কিংবা সমীক্ষাগত আলোচনায় না গিয়ে এর একটি সরল উত্তর হতে পারে; সেটি— মানুষ। সেই মানুষ; যে কয়েক হাজার বছর আগে সামষ্টিক সম্পদে ব্যক্তিগত অধিকার দাবি করে প্রথম উচ্চারণ করেছিল— ‘এটি আমার’। সেদিন থেকেই তো পৃথিবীটা সকলের থাকেনি। কালে কালে পরাজিত হয়েছে মানুষের স্বার্থের কাছে, টাকার কাছে। তবে এই ব্যবস্থাকে স্থায়ী বলে মানা যাবে না। এর থেকে মানুষের মুক্তি প্রয়োজন এবং সেটি যেভাবেই হোক। আবার সেই পুরনো প্রশ্নে ফিরি— একজন মানুষের বাঁচার জন্য, জীবন ধারণের জন্য, টিকে থাকার জন্য কতটুকু সম্পদের, অর্থের প্রয়োজন?

এটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে সেটি পাশ কাটিয়ে, নীরবে বলে দেওয়া যায়— খুব অল্প নিয়েও প্রাণপূর্ণ থাকা যায়, সভ্য থাকা যায়। সবথেকে বড় কথা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা যায়। এই সময়টা আদতে স্বল্প নিয়ে বাঁচার। মানুষের দৈবিক গ্রাসটাকে প্রশমিত করার। এ প্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র একটি দৃশ্যের অবতারণা করা যেতে পারে। দেশভাগের কারণে বাস্তুচ্যুত এক রিফিউজি, দারিদ্র্যক্লিন্ন বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক তার দুই প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে নিয়ে এক সকালে ভ্রমণে বেরিয়েছেন। কলকাতার যান্ত্রিক, রিফিউজি ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে তারা বাস থেকে নামলেন, সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বেশ এগিয়ে পৌঁছলেন প্রকৃতির কাছে। তারপর ধানক্ষেত ও জলাভূমির দিকে আধভাঙা চশমা চোখে, পিটপিট করে তাকিয়ে, উচ্ছ্বসিত বৃদ্ধ শিক্ষক সন্তানদের বললেন : ‘কীটসের ঐ পদ্য আছিল না! পোয়েট্রি অব আর্থ ইজ নেভার ডেড। এই যে ধাইন্যক্ষেত্র, এই শোভা নিরীক্ষণ করতে তো কোনো পয়সা লাগে না। পয়সা নাই— নাই! কিন্তু এইটা আছে, ভীষণভাবেই আছে।’ এটি এই শিক্ষাই দেয় যে, জীবনের সবকিছুকে পয়সা দিয়ে, অর্থ দিয়ে বিচার করা চলে না। বরং টাকার বাইরে যে জীবন আছে, পৃথিবী আছে; সেটি অনেক বড়, মহৎ। সৌন্দর্যের এবং মানুষের। টাকার কাছে হার না মেনে এই পৃথিবী গড়ার দিকে আমাদের এগুতে হবে। হ্যাঁ, সে পথ বড় বন্ধুর, ত্যাগের। তবে অসাধ্য তো নয়। হেমিংওয়ের সেই বিখ্যাত বুড়ো সান্তিয়াগোর কথা জানি— যে প্রায় মাস তিনেকের সংগ্রামের পর সাগরে একটা মাছ পেয়েছিল। তবে শত চেষ্টা করেও তীরে আনতে পারেনি। এনেছিল কেবল হাঙরে খেয়ে যাওয়া কঙ্কালটা। কিন্তু তারপরও আশাহত হয়নি। স্বপ্ন দেখেছে পুনরায় সাগরে যাওয়ার, মাছ শিকারের। আর আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেছে জীবন সম্পর্কে একটি চিরন্তন সত্য— ‘মানুষ পরাজিত হতে পারে না’। এই অপরাজেয়তাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। স্বল্প নিয়ে বাঁচার জন্য, আগামী পৃথিবীটা সকলের করে গড়ার জন্য এই শক্তি নিয়েই আমাদের এগুতে হবে।

 

লেখক : লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads