• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আমার মানুষেরা

  • প্রকাশিত ০৩ জানুয়ারি ২০২১

অর্বাক আদিত্য

 

 

 

ইতিহাস রচিত হয় বহুরৈখিকভাবে। তার উপরিতল নিচতল থাকে। অনেকে বলেন যাদের হাতে রচিত হয় তাদের বীরত্বই প্রাধান্য পায়। কিন্তু এই বলাকে সমর্থন করলে বোধহয় ইতিহাসের যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন, সেটি ঘটে না। পরাজিতেরও ইতিহাস থাকে। পলাশীর বিজেতা শক্তি ইংরেজরা হলেও ইতিহাসে উজ্জ্বল সিরাজদ্দৌলা। তবে এটা ঠিক সরকার, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা একই ভাষায় কথা বললে ইতিহাস থমকে দাঁড়ায়। অগ্রগতি থমকে দাঁড়ায়। থেমে যাওয়া সময়টারও ইতিহাস থাকে, কলঙ্কিত ইতিহাস। নিশ্চয়ই যে কেউ তার সময়কার কলঙ্ককে স্বীকার করবেন না বা দায় নিতে চাইবেন না। বাঙালি জাতি যুগ যুগ ধরে আত্মশ্লাঘাবোধ সম্পন্ন জাতি। যখন রাষ্ট্র ছিল না, সংবিধান ছিল না, রাজার শাসনে তখনো বাঙালিরা দ্রোহ করেছে-বিদ্রোহ করেছে আবার ভালোবেসে রক্তও দিয়েছে। অস্তিত্বের ওপর ছুরি ঘোরানো কখনো মানেনি, মানবেও না। ত্যাগের ইতিহাসও বুক ফুলিয়ে বলার মতো। ’৪৭ থেকে ’৭১ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জেল খেটেছে, সংসার ছেড়েছে, মাথায় হুলিয়া নিয়ে ছদ্মবেশ নিয়েছে; কিন্তু প্রতিবাদ, প্রতিহত অব্যাহত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ এক বৃহৎযুদ্ধ। একটা সময়ে ঘটে না। একটা পরিস্থিতিও ঘটে না। নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মুক্তির কাছে পৌঁছাতে হয়। বাধা আসে, মুক্তিটাকে বন্দি করার প্রয়াস করা হয় কিন্তু মুক্তির এমনি শক্তি যে- সব প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার পতাকাই পতপত করে উড়তে থাকে। আমাদের দেশ দীর্ঘসময় দেশবিরোধী শক্তির করায়ত্তে ছিল, তারও শৃঙ্খল আমরা ভেঙেছি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের কাছে দেশকে তুলে দিয়ে একটু নিশ্চিত হতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশা নিয়ত ভঙ্গের খবরে ছেয়ে গেছে। সামাজিক সংস্কৃতি গোলমেলে অবস্থায়, অর্থনীতি আকাশ-পাতাল বৈষম্য, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীরা আধিপত্য নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই আপন করার মতো আপামর মানুষের ভাবনা তাতে কোথায়? আমলা এবং পুলিশি ক্ষমতা যেন অনির্ণেয়, অপরিমেয়। কোভিডের কালেও স্বাস্থ্যখাত, রেলখাতে দুর্নীতির মহোউৎসব ছিল। শিক্ষাখাত ভেঙে পড়ার মতো। সড়ক দুর্ঘটনা অহরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ৫০ বছর অতিক্রম করেও প্রতিরোধ করতে হচ্ছে। সবটা দায় যে এই সরকারের তাও নয়। সবারই।

অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে; কিন্তু লড়াইটা যদি একা বঙ্গবন্ধুকন্যা করেন তাহলে সেই লড়াইটা তো কঠিন। অনেক ভিশন মিশন নেওয়া হয়েছে, প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই এই প্রোগ্রামগুলোতে যেন কোনো লুটপাট অনিয়ম দুর্নীতির খবর আমাদের হতাশ না করুক। একটা বছরের অবসান সাথে সাথে একটা দশকেরও। দশকটাও নানা কারণে বিতর্কিত। অবশ্য বিতর্ক ছিল বলেই, তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। আলোচনা হোক, সমালোচনা হোক, দেশ এগিয়ে যাক। সবিশেষ তো ক্ষমতা টিকে থাকে না, টিকে থাকে কৃতি। ইতিহাসে কত শাসক এসেছে, আবার গেছেও। কজনের নাম জানি? পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ সেইসব মানুষকে নিয়েই মার্চ করুক যারা মননগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর সতীর্থ, যারা চিন্তাগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যার সহযোদ্ধা। পোশাকি, মুখোশধারীদের সময়কে এখানেই থমকে দেওয়া হোক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকুক।

প্রকৃত শিক্ষাচিন্তকদের মেধা-মননকে কাজে লাগানো হোক। রাজনীতিতে ব্যবসায়ী, আমলা নয় প্রকৃত রাজনীতিকরাই আসুক, যারা দেশকে ভালোবাসবে, মানুষকে ভালোবাসবে। কৃষকের দুঃখ বুঝবে, শ্রমিকের প্রত্যাশা বুঝবে। গ্রাম বুঝবে, শহর বুঝবে। শিল্প বুঝবে এবং ব্যবসাও বুঝবে। বেকারের দীর্ঘশ্বাস বুঝবে। অনবরত ধ্বংসের ভেতর গড়ে ওঠার সংস্কৃতিচর্চা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু কেউ কেউ তো পারে। অসম্ভব তো নয়। সমস্ত হতাশার ভেতর জাতির ভরসা বঙ্গবন্ধুর ব্লাড মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। এমন একটা পরিবর্তন আসুক যেখানে প্রথম সারিতে প্রাধান্য থাকবে মানুষের। যেভাবে আপন করে ভাবতেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সবসময়ই বলতেন ‘আমার মানুষেরা’— এরকম ‘আমার মানুষেরা’ বলার মতো অসংখ্য বঙ্গবন্ধু তৈরি হোক বাংলাদেশে। আবারো কেউ ঘোষণা করুক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। যে মুক্তি আক্ষরিক অর্থে নয়, সত্যিকারের মুক্তি। এমনই প্রত্যাশা আমাদের। এমন প্রত্যাশা আজীবন ছিল। নতুন বছরে সঠিক জায়গায় ক্যামেরার ফোকাস পড়বে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads