• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

  • প্রকাশিত ০৫ জানুয়ারি ২০২১

জুলফিকার মতিন

 

 

 

জাতিসত্তার কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে শনাক্ত করে বাঙালি তার আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেছিল, কি জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল কিংবা সেই রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে কারা ছিলেন অথবা কাদের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, এ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সাহেবের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এবং সে দলের বর্তমান নেত্রী মিসেস জিয়ার পাকে প্রাকারে নীরব ভূমিকা গ্রহণ জাতীয় জীবনে সত্য-সত্যই বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরোক্ত বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে কেবল দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সাহেবের অবদানকে বড় করে তোলার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগও যেমন অভিযুক্ত হচ্ছে, তেমনি বাঙালি বললে হিন্দু বাঙালিদের থেকে মুসলিম বাঙালিদের আলাদা করা মুশকিল বলে রাষ্ট্রীয় দর্শনে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে পুনর্বাসিত করার প্রয়াস নতুন আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধযুগ পরে বিএনপি সংগঠনের জন্ম। এমন নয় যে সে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে জামায়াতে ইসলামীর মতো। বরং তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সাহেব ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। তাঁরও কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চট্টগ্রাম থেকে। কাজেই বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে সংগঠনের অস্তিত্বই ছিল না, সে সংগঠন স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে ভোগে কেন, কেন স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল জিয়াউর রহমান সাহেবের ওই ঘোষণাটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকে, এমনকি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে তিনি কী করেছেন, কীভাবে করেছেন, কোথায় থেকেছেন— কেন তার বিবরণ দেয় না— তার জবাব কী? সেটি কি কেবল শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর দল আওয়ামী লীগের কৃতিত্বটাকে খাটো করে দেখানোর জন্য? হতে পারে জাতির একটা বিশেষ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর দল আওয়ামী লীগের ওপর একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছিল। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিএনপি কোনোভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নাকি এটা ঘটেছে বিএনপি দলের দক্ষিণ মেরুকরণের ফলে? সন্দেহ নেই, ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন জারির ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় আসেন, তখন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলের কাছে সামরিক শাসন কেন ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়নি? তারা জিয়াউর রহমান সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাসানীপন্থি ও অন্যান্য বামপন্থি, যারা তত্ত্বগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন— সবাই সমবেত হন তাঁকে মদত জোগাতে। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান তাদেরকেই খিচুড়ি পাকিয়ে প্রথমে জাগদল এবং অতিসত্বর সেই দল ভেঙে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম দেশগুলো আতর খুশবু বিতরণ করতে থাকে প্রবলভাবে। সুতরাং স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলে তিনি ধর্মীয় লেবাস পরাটাকেই বিবেচনা করতে থাকেন ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার রক্ষাকবচরূপে।

ভাবতে অবাক লাগে, বাঙালির জাতিসত্তা নির্মাণ ও তার রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে একসময় জিয়াউর রহমান ভিন্নরকম ধারণা পোষণ করতেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলার প্রথম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘একটি জাতির জন্ম/জিয়াউর রহমান’ রচনায় এটি দেখা যায়।  সেখানে তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের বিদ্বেষমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের মানস-বিবর্তনের রূপরেখা প্রদান করেছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণে জর্জরিত বাঙালি জাতি কী করে নিজস্ব জাতীয়তা চিহ্নিত করে— বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্র উচ্চারণ করে অনিবার্য স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছে তাও ব্যক্ত করেছেন প্রত্যয়দীপ্ত ভঙ্গিতে।

পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কী চোখে দেখেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘স্কুলজীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অসচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে। স্কুলজীবনেই সেদিন শুনেছি আমার স্কুলবন্ধুদের আলোচনা। তাদের অভিভাবকেরা বাড়িতে যা বলতো, তা-ই তারা রোমন্থন করতো স্কুল প্রাঙ্গণে। তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হতো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশকে শোষণ করার বিষয়। পাকিস্তানী তরুণ সমাজকে দেখানো হতো বাঙালিদের ঘৃণা করতে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উগ্র করে দেওয়া হতো স্কুলছাত্রদের শিশুমনেই। শিক্ষা দেওয়া হতো বাঙালিদের নিকৃষ্ট জাতিরূপে বিবেচনা করতে।’

এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আকাঙ্ক্ষাটুকুও ব্যক্ত করেছেন অকপটে : ‘সেই স্কুলজীবন থেকেই মনে মনে আমার এই আকাঙ্ক্ষা লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে, তাহলে এই পাকিস্তানিদের অস্তিত্বেই আঘাত হানবো। সযত্নে এই ভাবনাটাকে আমি লালন করতাম। আমি বড় হলাম। সময়ের সাথে সাথে আমার সেই কিশোর মনের ভাবনাটাও পরিণত হলো। জোরদার হলো। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার দুর্বারতম আকাঙ্ক্ষা দুর্বার হয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই। উদগ্র কামনা জাগাতো পাকিস্তানের ভিত্তিভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাঙ্ক্ষাকে।’

কী কারণে আর কীভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন তা বোঝার জন্য রচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। সাথে জাতীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার মতামত। বস্তুত এর ভেতর দিয়েই তার রাজনৈতিক মতের প্রতিধ্বনি ঘটেছে।

রচনাটির শুরুতেই বলেন : ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি. জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে সেদিনই বাঙালির হূদয়ে অংকুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতির।’

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়ার কথাটাও আছে : ‘১৯৫২ সালে মশাল জ্বললো ভাষা আন্দোলনের। আমি তখন করাচীতে। দশম শ্রেণীর ছাত্র। পাকিস্তানী সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম, পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবী, সরকারী কর্মচারী, সেনাবাহিনী আর জনগণ সবাই সমানভাবে তখন নিন্দা করেছিল বাংলা ভাষার। নিন্দা করেছিল বাঙালিদের। তারা এটাকে বলতো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা এটাকে মনে করেছিল এক চক্রান্ত বলে। একসুরে তাই তারা চেয়েছিল এটাকে ধ্বংস করে দিতে। আহ্বান জানিয়েছিল এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের। কেউ বলতো বাঙালি জাতির মাথা গুঁড়িয়ে দাও। কেউ বলতো ভেঙে দাও এর শিরদাঁড়া।’

স্মৃতিমূলক ও বিশ্লেষণমূলক রচনাটিতে জিয়াউর রহমান অন্তত দুবার পাকিস্তানকে ‘অস্বাভাবিক রাষ্ট্র’রূপে বর্ণনা করেছেন। পাকিস্তানের জন্ম প্রসঙ্গে বলেন : ‘ভারত ভেঙে সৃষ্টি হয়েছিল অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের।’

মি. জিন্নাহর ঘোষণার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন : ‘পাকিস্তানের স্রষ্টা নিজেই ঠিক সেদিন অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজটিও বপন করে গিয়েছিল এই ঢাকার ময়দানেই।’

রচনাটিতে এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ডেভেলপমেন্টের কথা আছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয় সম্পর্কে বলেছেন : ‘১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের বিজয় রথের চাকার নিচে পিষ্ট হলো মুসলিম লীগ। বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক যুক্তফ্রন্টের বিজয় কেতন উড়ল বাংলায়। আমি তখন দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্যাডেট। আমার মনেও জাগলো পুলকের শিহরণ।’

আইয়ুবের সামরিক দশক সম্পর্কে অভিমত : ‘আইয়ুব খানের নেতৃত্বে চালিত এক প্রতারণাপূর্ণ সামরিক শাসনের কালো দশক। এই তথাকথিত উন্নয়ন দশকে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতিকে বিকৃত করার। আমাদের জাতীয়তাকে খাটো করার।’

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে : ‘স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এটিও ছিল অঙ্গুলি সংকেত। এই মামলার পরিণতি এক করে দিল বাঙালি সৈনিক নাবিক ও বৈমানিকদের।’

জিয়াউর রহমানের লেখাটি পড়ে স্পষ্টত বোঝা যায়, বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমর্থন ছিল আকুণ্ঠ। যতবার শেখ মুজিবের নাম উল্লেখ করেছেন প্রত্যেকবারই লিখেছেন ‘জাতির পিতা, জনক, বঙ্গবন্ধু’। হতে পারে এই প্রয়োগ আলঙ্কারিক কিন্তু যখন বলেন : ‘আখ্যায়িত করত আমাদের আওয়ামী লীগের দালাল বলে। একাডেমীর ক্লাসগুলোতেও সবসময় বোঝানো হতো আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতের দালাল। পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করতেই আওয়ামী লীগ সচেষ্ট। এমনকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ক্যাডেটদের শেখানো হতো— আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিব হচ্ছেন ওদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।’ তখন বক্তার অন্তর্নিহিত প্রশ্রয়টুকু না বোঝার কী থাকে?

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে গ্রিন সিগন্যাল ধরে তাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দেন। অথবা যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ করার খবরটি ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, ডিআইজির সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও জানাতে টেলিফোন অপারেটরকে অনুরোধ জানান। তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বই ছিল তার কাম্য।

যে ইতিহাস ও মননের ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমান জার্নি করেছেন, জীবদ্দশাতেই সেই সত্য থেকে দূরে সরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমা ক্রমাগত জটিল হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। বিরুদ্ধ শক্তি যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনি স্বপক্ষের শক্তিও পাল্টে গিয়েছিল। বদলে গিয়েছিল। ক্ষমতাই হয়ে উঠেছিল প্রধান লক্ষ্য। দেশ, মানুষ, সংস্কৃতি নিয়ে যে ভাবনা ছিল তা যেন অতীত হয়ে গিয়েছিল সবার ভেতর থেকে। এরকম ঘনঘন রাজনৈতিক ডিগবাজিই বাংলাদেশকে তার অগ্রগতির পথে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে যে ইতিহাসের দিকে দেশ টার্ন করেছে— সেটিকে বিবেচনার কাল হয়তো এখনো আসেনি। তবে শুভ বা কল্যাণকর কিছু প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads