• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু, এক ইতিহাস নির্মাতার নাম

  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২১

মফিদুল হক

 

 

 

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের নন্দিত নায়ক হিসেবে ক্রমে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। সেইসঙ্গে একথাও স্মরণ করতে হয় তিনি বাংলার ইতিহাসের নিন্দিত নায়কও বটে এবং তাঁর নিন্দাবাদে মেতে-ওঠা কিংবা তাঁকে উপেক্ষা করে ইতিহাস রচনার মানুষের কোনো অভাব ঘটেনি এবং বাঙালিরাই এখানে পালন করেছে বড় ভূমিকা। এসব নিন্দাস্রোতে এক বড় অধ্যায় রচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান কারাগারের অন্ধকূপে বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর লন্ডন গমন এবং সেখান থেকে দেশে ফেরার সময়টুকু ঘিরে। যারা তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ এমন সব বিবরণ দাখিল করেছেন, যেখান থেকে মনে হবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ, এমনকি তার দেশ যে স্বাধীন হয়ে গেছে এটাও নাকি তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে এটা বোঝানোর দায়িত্ব তারা পালন করেছেন এমন অবিশ্বাস্য দাবিদার বাঙালি পরে গজিয়ে উঠেছিল আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে। এদের একজন বিবিসির সিরাজুর রহমান পরে লিখেছিলেন, তিনিই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন পাকিস্তানিরা বর্বর হামলা চালিয়ে তিন লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। তার মতে, এই তিন লক্ষ নিহত নাগরিকের কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বঙ্গবন্ধু নাকি তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা বলেছিলেন। লন্ডনে কর্মরত আরেক কূটনীতিক, পরবর্তীকালে যিনি বিএনপি-তে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি দাবি করেছেন- বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে তিনি হিথরো বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এবং তার গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুকে ক্ল্যারিজ হোটেলে নিয়ে আসেন। সেই সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করেন।

এমন সব দাবির মুখে আমাদের হাতে আসে এক ঐতিহাসিক চিঠি যা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লিখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন পৌঁছান এবং সেই সন্ধ্যাতেই ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎকারের পর এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করেন। এর দুদিন পরই শেখ মুজিবের সঙ্গে তার আলাপের বিবরণ দিয়ে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দীর্ঘ পত্র লেখেন। এই পত্রই হতে পারে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি এবং ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান অবলম্বন।

মুক্তি দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে এনে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে পুলিশ একাডেমির সিহালা গেস্ট হাউজে রাখা হয়। সেখানে পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলকারী নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সঙ্গে দেখা করেন এবং এক ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা হয়। একজন নয়দিন আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, আরেকজন নয় মাস আগে নির্বাচিত হয়েছেন নব-উদ্ভূত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। বন্দি এবং ত্রাণকর্তার মধ্যে কথোপকথন নয়, সমতার ভিত্তিতেই আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু, যদিও পাকিস্তানিদের হাতে আটক হিসেবে তার অবস্থান ছিল নাজুক। এই সাক্ষাতের যে বিবরণী দিয়েছিলেন ভুট্টো তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, তবে এটা বোঝা যায় ভুট্টো পীড়াপীড়ি করেছিলেন বাংলাদেশ-পাকিস্তান কোনো ধরনের কনফেডারেশন বহাল রাখার লক্ষ্যে। সেটা বঙ্গবন্ধু মেনে নেননি, বলেছিলেন স্বদেশে ফিরে তিনি অভিমত জানাবেন। অন্যদিকে ভুট্টো তাকে বিমানে পাঠাতে চেয়েছিলেন তেহেরান কিংবা আঙ্কারায়, যে-প্রস্তাবে শেখ মুজিব সম্মত ছিলেন না। এই আলোচনা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় প্রতিকূল অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সফল ছিলেন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বাস্তবতা সম্পর্কে বিস্তারিত না জানতে পারলেও পরিস্থিতি বুঝতে তার কোনো ভুল হয়নি। উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় তার লন্ডন অবতরণ ঘটেনি, একজন রাষ্ট্রনায়ক ও জননেতার মতোই তিনি লন্ডন পৌঁছেছিলেন। অবতরণের পর দুই ব্রিটিশ কর্মকর্তা বিমানে প্রবেশ করে তাকে লাউঞ্জে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাকে বহনকারী পিআইএ’র ক্যাপ্টেনের কাছে বঙ্গবন্ধু জানতে চান এরা ব্রিটিশ ফরেন অফিসের লোক কি-না। ক্যাপ্টেন জানান, এরা প্রটোকলের লোক এবং তাকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যেতে এসেছেন।

বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকামাত্র ঘটে এক হূদয়সংবেদী অপ্রত্যাশিত দৃশ্য। কর্তব্যরত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট করে অশ্রুসজল চোখে জানায়, ‘স্যার, আমরা আপনার জন্য সবসময় প্রার্থনা করেছিলাম।’ লাউঞ্জে প্রবেশের পরপর ফোন এসেছিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ডের কাছ থেকে। তিনি জানান, মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে তারা বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর পেয়েছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনের বাইরে আছেন বিধায় বিমানবন্দরে আসতে পারছেন না, সাদারল্যান্ড দ্রুতই এসে পৌঁছবেন।

ইতোমধ্যে পাকিস্তানের হাই কমিশনার নাসিম আহমেদ বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, স্যার, আপনার জন্য আমরা কী করতে পারি? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনারা যথেষ্ট করেছেন, আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। ইয়ান সাদারল্যান্ড বিমানবন্দরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান এবং বলেন, ক্ল্যারিজ হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন মধ্য লন্ডনে রাসেল স্কোয়ারের কাছে কোনো মানসম্মত হোটেলে থাকবেন, তাহলে বাঙালিদের তার সঙ্গে দেখা করতে সুবিধা হবে। কিন্তু সাদারল্যান্ড জানান, বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা ক্ল্যারিজেই থাকেন এবং বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দিকটিও দেখার রয়েছে।

হোটেলে পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু ফোনে কথা বলেন পরিবারের সদস্য এবং তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে। দেশের বৃত্তান্ত তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। সারাদিন নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ চলে। সন্ধ্যায় তিনি যান ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতে। বাংলাদেশ তখন কোনো স্বীকৃত রাষ্ট্র নয়, ভারত ও ভুটান ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি; কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়েছিল এবং এডওয়ার্ড হিথ তার চাইতেও কিছু বেশি।

উভয় নেতা এক ঘণ্টাজুড়ে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। তারপর বের হয়ে প্রটোকল অনুযায়ী করমর্দন করে উভয় নেতা দরজার সামনে দাঁড়াবেন, রাস্তার ওপারে অবস্থানরত ফটোগ্রাফাররা আনুষ্ঠানিক সেই ছবি তুলবেন। দুই নেতা দাঁড়িয়ে, পেছনে দরজায় লেখা ১০ নং। প্রথা অনুযায়ী ছবি তোলা শেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চলে যান ভেতরে, প্রটোকল অফিসার অতিথিকে তুলে দেন তার গাড়িতে। তবে এক্ষেত্রে এডওয়ার্ড হিথ ঘরে ফিরে গেলেন না। তিনি এগিয়ে এসে নিজের হাতে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানালেন।

দুদিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে যে-পত্র লিখেছিলেন এডওয়ার্ড হিথ, সেটা ঐতিহাসিক মূল্য বহন করে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরিত পত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন :

 

“এক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান যখন লন্ডন এসেছিলেন, তার সঙ্গে আমার এক ঘণ্টার আলোচনা বিশেষ আগ্রহোদ্দীপক ছিল। মুজিবের আগমন ছিল অপ্রত্যাশিত। তার আসার কথা আমরা প্রথম জানতে পারি ইসলামাবাদ থেকে প্রেরিত বার্তায় যখন তাকে বহনকারী বিমানটি ছিল মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে। পরে মুজিব আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি ভুট্টোকে বলেছিলেন তাকে ঢাকায় পাঠানো হোক, অথবা রেড ক্রস কিংবা জাতিসংঘের কাছে তুলে দেয়া হোক। এসব প্রস্তাব অবশ্য ভুট্টোর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। মুজিব স্বয়ং তেহেরান যেতে অস্বীকার করেন এবং শেষ পর্যন্ত লন্ডন আসতে সম্মত হন। আমার মনে হয়েছে মুজিব কারাবাস ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছেন। যদিও দৃশ্যত নিঃসঙ্গ কারাবাসের কারণে তিনি ক্লান্ত এবং নয় মাসের ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত নন, তা সত্ত্বেও তিনি আস্থা ও প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেন। যত শিগগির সম্ভব ঢাকায় যেতে তিনি উদগ্রীব ছিলেন এবং আমরা তার জন্য রাজকীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করি। এটা তার অভিপ্রায় ছিল যে, দিল্লি থেকে তিনি কোনো ভারতীয় বিমানে যাত্রাবদল করবেন না।

মুজিব আমাকে জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংযোগের কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। মুক্তির আগে ভুট্টোকে সে-কথা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার বক্তব্য বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সমর্থন করে। যদিও তিনি পূর্বতন (অর্থাৎ ইয়াহিয়া) সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে তিক্তভাবে কথা বলেন, ভুট্টো সম্পর্কে ততটা ক্ষোভ তার ছিল না।

শেখ মুজিব কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমি তাকে আমাদের সদিচ্ছা সম্পর্কে জানিয়ে ব্যাখ্যা করে বলি কেন আমরা এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারছি না। উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক বিষয়ে, তিনি আমার সঙ্গে একমত হন।”

পত্রশেষে এডওয়ার্ড হিথ জানান, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পশ্চিমা দেশগুলোর অহেতুক বিলম্ব করা উচিত হবে না। এই বক্তব্য স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় কীভাবে বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালির নেতা নন, বিশ্ব-কাতারের একজন নেতা হয়ে উঠেছিলেন, এমনকি চরম কঠিন সময়েও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads