• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা

  • প্রকাশিত ০৯ জানুয়ারি ২০২১

প্রফেসর ড. আবদুল খালেক

 

 

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশের জন্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হাজার বছরের পরাধীন বাংলাদেশ যার নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে, তিনি স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছেন। যেহেতু একটি দেশের উত্থানের সঙ্গে তিনি জড়িত, সুতরাং দেশটির সূচনালগ্নে যেসব বিষয় বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভাবিয়েছে, তাঁর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষা যেহেতু একটি জাতির মানস গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে, সেহেতু বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রগঠনে এই দিকটির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনাকে তাই দেখতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পটভূমি ও বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।

১৯৪৭ সাল থেকে এই ভূখণ্ডে যত রকমের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ঘটনা ঘটেছে, বঙ্গবন্ধু সেগুলোর সাথে একাত্ম হয়েছিলেন। তিনি নিজেকে ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে কখনো দূরে রাখেননি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, পাকিস্তান আমলে নানারকম বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেগুলোর প্রতিবাদে এ দেশের ছাত্র-জনতা বার বার শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলন করেছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মোট ছয়টি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ১৯৫২ সালে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯ সালে এস এম শরীফ শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৯ সালে এস এম নূর খান শিক্ষা কমিশন এবং ১৯৭০ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই শিক্ষা কমিশন দেশকে কার্যকর কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা দিতে পারেনি বরং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শিক্ষা বিষয়ে তাদের বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে বাংলার মানুষ আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করেছে।

একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময় জনগণের আবেগ ও অনুভূতিকে অনুধাবন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষানীতির বৈষম্যমূলক সুপারিশের প্রতিবাদে বাংলার ছাত্র-জনতা যখন মাঠে নেমেছে, তখন শেখ মুজিব ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীবৃন্দ সব সময় ছাত্র-জনতার পাশে থেকেছেন। জনগণের পাশে থাকার এ বিষয়টিকে শুধু যে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের চাহিদা ও মনোভাবকে সমর্থন করা বিষয়টি তেমন নয়, বরং শেখ মুজিব বিষয়টিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার পর নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যুদ্ধবিধ্বস্ত নবগঠিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করবার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণের এবং ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার সাথে নিরক্ষরতার যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায়, তাহলে বলতেই হবে শিক্ষিত জাতিই একটি পরাধীন দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, নিরক্ষর জনগোষ্ঠী কখনো কোনো পরাধীন দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে না। শিক্ষার সাথে দেশপ্রেম কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভালো করেই জানতেন জাতিকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে জাতির মুক্তি নেই।

আমরা জানি শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। ফরিদপুর শহর থেকে গ্রামটির দূরত্ব ছিল বিস্তর, যাতায়াত ব্যবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। দুর্গম এলাকাই বলা যায়। এলাকার মানুষ ছিল দরিদ্র। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এলাকার নিরক্ষর মানুষদের কীভাবে অক্ষরজ্ঞান দান করা যায়, কিশোর শেখ মুজিব এ ব্যাপারে ছিলেন তৎপর। কিশোর শেখ মুজিব শিক্ষার আলো বিস্তারের জন্য সর্বপ্রথম তার গ্রামকেই বেছে নেন। গ্রামের নিরক্ষর বয়স্ক মানুষদের স্বাক্ষর করার কাজে কিশোর বয়সেই তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। গ্রামের মানুষদের সাথে নিয়ে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের অক্ষর চেনানোর জন্য স্কুলগৃহ নির্মাণ করেছেন। গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে মুষ্টির চাল নিয়ে স্কুলের খরচ বহন করেছেন। এটি শেখ মুজিবের কিশোর বয়সের শিক্ষাভাবনার উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এসব বিষয়ের উল্লেখ আছে।

শেখ মুজিব স্কুল পর্যায়ে লেখাপড়া করেছেন নিজ এলাকায়। কলেজ পর্যায়ের লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করতে গিয়ে তিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। এর ফলে শেখ মুজিবের অন্তরে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। দেশ তখন এক ক্রান্তিলগ্নে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতা অর্জনের পথে। ১৯৪৪-৪৭ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের কলকাতা জীবন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে দেশে দেখা দেয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ফলে মুসলমানদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি শেখ মুজিবের মতো রাজনীতি সচেতন মানুষ। তবে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে থেকে শেখ মুজিব যে ধরনের পাকিস্তান চেয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালে সে পাকিস্তান অর্জিত হয়নি। বাংলার বিভাজন শেখ মুজিব চাননি। অনেক চেষ্টা করেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তরুণ শেখ মুজিব বাংলার বিভাজন ঠেকাতে পারেননি। দেশ ভাগ হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তত্ত্বই শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়। মুসলমান প্রধান এলাকা হবে পাকিস্তান, হিন্দু প্রধান এলাকা হবে হিন্দুস্তান। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পর শেখ মুজিবকে চলে আসতে হয় ঢাকায় ১৯৪৭ সালে। ততদিনে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

শেখ মুজিবের শিক্ষাভাবনা এবং রাজনৈতিক ভাবনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতি যেমন জীবন বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়, শিক্ষাকেও বঙ্গবন্ধু জীবন বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি কখনো। যে কারণে ব্যক্তি জীবনে স্কুল-কলেজে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি চর্চা করেছেন। ১৯৪৮ সালে দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি গঠন করেছেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামের একটি সংগঠন। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের জন্ম। শেখ মুজিব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা না হয়, বাঙালি জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতি পিছিয়ে পড়বে। তিনি বুঝতে পারেন বাঙালি জাতিকে আর একটি স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হতে হবে। উর্দুকে যখন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়, শেখ মুজিব উপলব্ধি করতে পারেন শিক্ষা থেকে তার দেশের মানুষ বঞ্চিত হবে। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতনের ফলে শেখ মুজিবের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া প্রকৃত অর্থে শিক্ষা সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবের যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটানো, ১৯৭০ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা—সবকিছুর মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমিক ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠনের অক্লান্ত প্রয়াস।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেলখানায়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেই উপলব্ধি করতে পারেন পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী দেশকে বিধ্বস্ত করে রেখে গেছে। এ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে হলে মানবসম্পদকে কাজে লাগানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন শিক্ষা। শিক্ষাকে শৃঙ্খলায় আনতে গেলে প্রয়োজন একটি সুশৃঙ্খল নীতিমালা। শিক্ষার নীতিমালা পেতে হলে প্রথমে প্রয়োজন একটি রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিমালা। কাজেই বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম দেশের সংবিধান রচনায় হাত দেন। সংবিধানের আলোকেই তিনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজানোর কথা ভেবেছিলেন। অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে দেশে ফিরে এসে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। দ্রুত কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবনের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগোতে গিয়ে নিজের মনের গভীরে দেশের সংবিধানের একটি ছক তৈরি করে রেখেছিলেন। যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরে ১৩/১৪ বছর বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে, সম্ভবত সেই জেলে বসে থেকেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি করে ফেলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই রচিত সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে। সংবিধানে ৪টি মূলনীতি স্থান পায়, যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সংবিধানের নীতিমালার আলোকেই ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ দেশের কৃতী সন্তান, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৮ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসককে নিয়ে কমিশনটি গঠিত হয়। এটি সঙ্গত কারণেই ‘খুদা শিক্ষা কমিশন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা পুরোটাই প্রতিফলিত হয়েছে ‘খুদা শিক্ষা কমিশনে’। খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা অবিচ্ছিন্ন। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে হলেও শিক্ষাই প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তাচেতনায় প্রাগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।

পাকিস্তান সরকার দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনকালে শিক্ষার জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের শাসনভার হাতে নেওয়ার মাত্র ৯ মাসের মধ্যে ‘খুদা শিক্ষা কমিশন’-এর মাধ্যমে  আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত একটি শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দিতে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘খুদা শিক্ষা কমিশন’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ভূমিকায় বলা হয়েছে, বর্তমান শিক্ষায় নানাবিধ অভাব ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠনের নির্দেশ দান এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশেই সরকার এ কমিশন নিয়োগ করে। ৩০ মে, ১৯৭৪ তারিখে ৩৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৪৩০ পৃষ্ঠার (মুদ্রিত) এ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা পুরোটাই প্রতিফলিত হয়েছে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে।

দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছেন শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণের ও ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। দেশপ্রেম এবং সুনাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা প্রত্যেক নাগরিককে অবশ্যই তার নিজের দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতে হবে। এই দেশপ্রেম বলতে কোনো অস্পষ্ট ভাবাবেগপূর্ণ অনুভূতির কথা বোঝায় না। বাংলাদেশের আদর্শের যথার্থ উপলব্ধির কথাই বোঝায়। এর লক্ষ্য হচ্ছে জাতির ঐতিহ্যে গর্ববোধ করা, তার বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে উৎসাহী হওয়া এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃঢ় আস্থা পোষণ করা। দেশপ্রেমের মূল অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকটি নাগরিক জাতীয় সংহতিবোধে উদ্বুদ্ধ হবে এবং জনগণের সমষ্টিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠবে। সে অনুভব করবে যে, সে দেশের একজন, যেমন সে তার পরিবারের একজন। সে আরো অনুভব করবে যে, দেশের ভাগ্যে ভালোমন্দ যা কিছুই ঘটে তা যেন তার নিজের ভাগ্যেই ঘটছে।

সুনাগরিক সৃষ্টিতে এবং সমাজের প্রগতিশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক যেন জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভাবধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং চিন্তাচেতনায় দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিকরূপে গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য যে সংবিধান রচনা করেছিলেন সেখানে দেশপ্রেমিক এবং সুনাগরিক গড়বার লক্ষ্যেই সংবিধানের মূল লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সংবিধানের যে চার মূল নীতির কথা বলা হচ্ছে এটাই আসলে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন। দেশভাবনা, মানবভাবনা, শিক্ষাভাবনাকে বঙ্গবন্ধু আলাদা করে দেখেননি। বঙ্গবন্ধু আন্তরিকভাবে চেয়েছেন আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ শিক্ষার্থীদের চিত্তে জাগ্রত ও বিকশিত করে তুলতে এবং তারা বাস্তব জীবনে যাতে এর সম্যক প্রতিফলন ঘটাতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে।

বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হবে ‘মানবতা বা মানব কল্যাণ’। জাতীয় কল্যাণের স্বার্থে শোষণহীন নতুন সমাজ সৃষ্টির মহৎ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ বিশ্বের সকল সংগ্রামী মানুষের প্রতি বন্ধুত্ব ও একতার হস্ত প্রসারিত করতে হবে। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সৌহার্দ্য, প্রীতি, মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু নৈতিক শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন জ্ঞান শুধু কর্মদক্ষতা ও কৌশল অর্জন নয়, শিক্ষার্থীর মনে মৌলিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মে ও চিন্তায়, বাক্যে ও ব্যবহারে যেন সে সব সময় সততার পথ অনুসরণ করে। চরিত্রবান, নির্লোভ ও পরোপকারী হয়ে ওঠে এবং সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন যুব-মনে মূল্যবোধ সৃষ্টি ও তাদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাঠ্যক্রমে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পরিবেশে তার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষকতায় যাতে বহু প্রত্যাশিত উচ্চ নৈতিক মানের সৃষ্টি হয় সে জন্য সত্যিকার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও নিপুণ শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষকদের সততা, নিরপেক্ষতা, কঠোর পরিশ্রম এবং ছাত্রদের প্রতি প্রকৃত দরদও অবশ্যই আয়ত্ত করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঐক্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে যে কল্পনা, উদ্যম ও সাহসিকতার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে সেইসব গুণাবলির উন্মেষের জন্য আমাদের অবশ্যই ব্রতী হতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সব সময় সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার রূপে দেখতে চেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দীর্ঘদিনের শোষণ জর্জরিত সমাজে দ্রুত সামাজিক রূপান্তর ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষাকে বিশেষ হাতিয়ার রূপে প্রয়োগ করতে হবে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির স্বার্থে সকল নাগরিকের মধ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা লাভের সুযোগ-সুবিধার সমতাবিধান দ্বারা জাতীয় প্রতিভার সদ্ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ যাতে স্ব-স্ব প্রতিভা ও প্রবণতা অনুযায়ী সমাজ জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীল ক্ষমতা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে, সে জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে তার বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দক্ষতা সৃষ্টিরও বন্দোবস্ত করতে হবে। নানাবিধ কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অনাচার ও দুর্নীতি অবসানের অনুকূল বিজ্ঞানমুখী, আদর্শবাদী ও সামাজিক উন্নয়নের পরিপোষক মনোভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম মান পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন ভাষণে প্রয়োগমুখী অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল শিক্ষার কথা বলেছেন। দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতির উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির বিশাল দায়িত্ব শিক্ষা ব্যবস্থার। বঙ্গবন্ধু যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশ বিধ্বস্ত একটি দরিদ্র দেশ। আমাদের জীবনযাত্রার মান পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত জাতির তুলনায় অনেক নিম্নস্তরে। জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি সামাজিক পুঁজি বিশেষ। জনসাধারণের শিক্ষা লাভের সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচিত হয়। প্রধানত একটি দেশের সকল স্তরের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার আয়োজনের ফলেই জাতীয় সম্পদের ব্যাপক অগ্রগতি সম্ভব হয়। সে অগ্রগতিকে দ্রুততর করে তোলার জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী করে তোলা প্রয়োজন। আমাদের বিপুল জনশক্তি কর্মে নিয়োজিত হলে এবং আধুনিক সমাজের উপযোগী বিভিন্নমুখী দক্ষতা অর্জন করলে অনিবার্যভাবে জাতীয় সম্পদ সমৃদ্ধ হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads