• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

অধোন্নতি

  • প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারি ২০২১

অর্বাক আদিত্য

 

সত্য ও মিথ্যা এখন একাকার। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্য ঠাওর করা মুশকিল হয়ে গেছে। সত্য ও মিথ্যার এই যে দ্বন্দ্ব এটা এতটা তৈরি হতো না। কিন্তু রাজনীতি সত্য ও মিথ্যাকে ঘোলাটে করে দিয়েছে। সকালে এক রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে রাতে পাঁচ তারকায় যখন নিজেই দুর্নীতির ছক করেন তখন তার মুখাশ্রিত সত্য আর সত্য থাকে না, মিথ্যে হয়ে যায়। এই সুযোগে প্রতিমত তৈরি হয়। প্রতিমতটা দাঁড়ায় সুচতুরভাবে, বিরোধপূর্ণ পরিবেশে। রাজনীতি যখন আমাদের একবার ডানে একবার বাঁয়ে তাকাতে বাধ্য করছে তখন স্বাভাবিকভাবে আমরা সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমাদের নিজেদের বিবেচনার পর্যন্ত সময় পাওয়া যায় না। এইটা একটা গেমের মতো, এক স্টেপে বেশিদিন থাকে না। মোড় নেয়। কোনদিকে মোড় নেয়? একইভাবে মোড় নেয় শুধু বিষয় এবং কনটেন্ট পরিবর্তন করে। যেমন, আজ নির্বাচন তো কাল কালভার্ট। আজ খুন তো কাল ডিজে পার্টি। আজ ধর্ষণ তো কাল জুয়া ক্যাসিনো। এরকম। এই যে একটার পর একটা ফুরানোর আগে আর একটার কাছে পৌঁছাতে হচ্ছে। তো তার ভেতর সত্য ও মিথ্য বিবেচনার সুযোগ পর্যন্ত থাকছে না। তখন সেই বিষয়গুলোকে নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলে। সত্য ও মিথ্যের নির্ণয় চলে। কে, কীভাবে দেখেন, তার ওপর নির্ভর করছে কনটেন্টের সত্য। এখানে রাজনীতি এসে রং লাগায় আর তাতে ফাঁক-ফোকরে মূল সত্যটা আড়াল হয়ে যায়। গায়েব হয়। এভাবে একটার পর একটা।

দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল সাংবাদিক বন্ধু আশিক রিমেলের সাথে, তিনি বিষয়টাকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করলেন। একটা নতুন শব্দ দিয়ে। শব্দটা অবশ্য নতুন নয়। অসমীয়া ভাষার। ‘অধোন্নতি’। অধোপতন এবং উন্নতি শব্দ দুটো একসাথে সংসার পেতেছে ‘অধোন্নতিতে গিয়ে। তিনি বলছিলেন, উন্নতি বলতে আমরা কি বুঝি? সামনে অগ্রসর হওয়া। একটা গাছের উন্নতি তার শিকড়ে হয় নাকি কাণ্ড-লতায়-পাতায়? শিকড় তো মূল। এখন শিকড় বাড়ে কোন দিকে? বা অগ্রসর হয় কোন দিকে? নিচের দিকে। নিচের দিকে যাওয়াটা হচ্ছে অধঃপতন। কিন্তু আমরা তো এটাকেও উন্নতি বলি। বা বলতে হবেই। কাজেই এই উন্নতিটা হচ্ছে ‘অধোন্নতি’।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে ব্রিজ কালভার্ট হচ্ছে। আবাসিক এলাকা, শিল্পঅঞ্চলও হচ্ছে। কিন্তু আয়বৈষম্য? আমরা হয়তো একটা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি কিন্তু সেটি কি অই ‘অধোন্নতি’র মতো নয়? ইউরোপে সমাজতন্ত্র এলো, মানুষ ভাবল মুক্তি মিলবে। কিন্তু মিলল না বরং চরম দারিদ্র্য আর হতাশার মধ্যে পড়ল সবাই। রাষ্ট্র দায়িত্ব নিল। থাকার ব্যবস্থা করল। খাওয়াটাকে কোনোরকমে নিশ্চিত করল। কিন্তু মানুষের বলার স্বাধীনতা নেই। মোটকথা সবকিছু পেয়েও যেন স্বাধীন হতে পারল না, যার ফলে তারা সেকেন্ড রিভিউলিশন করল, সমাজতন্ত্র ভেঙে আবার এসে জুটল পুঁজিতন্ত্রের দিকে। মানুষের মুক্তি ও চাওয়া-পাওয়া আসলে কোথায়, সেটি বুঝতে হবে। ইতিহাসে এর দলিল আছে।

একথা সত্য, আমাদের দেশে ক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারকরা ফেরেস্তা হয়ে যান। তখন মনে হয় তাদের চোখ খুলেছে। সত্যটা দেখছেন এবং বলছেন। যাক এবার বোধ হয় একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আসে না। কারণ, অই সত্যটা আসলে শুধু বরাতের ভূমিকা পালন করে, যা ব্যবহার করে মসনদের কাছে পৌঁছানো যায়। তাহলে কি এরকমই চলবে?

ব্যক্তি প্রতিক্রিয়াশীল হলে, সমস্যাটা হয় ঘরের ভেতর কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়াশীল হলে সমস্যাটা সংক্রমিত হয় ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। কারণ, প্রতিহতের শক্তি। ব্যক্তিকে সহজে প্রতিহত করা যায়, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করতে হলে বহু সময় লাগে। অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কেনোদিকে গড়ায় তাও বলা যায় না। ৫২-তেই তো আমরা অনেকটা বুঝে গিয়েছিলাম, এখন সময় কেমন, পরিস্থিতি কী এবং করণীয় কী? কিন্তু সেটিকে ফাইনাল একটা জায়গায় পৌঁছাতে ২৪ বছর লাগল। জেলের ভেতর সংসার পাততে হলো বঙ্গবন্ধুকে। ব্যক্তি সহজ সমাধানে পৌঁছাতে পারে’ কিন্তু রাষ্ট্রকে ভাবতে হয় আরো সুদূর। আকাশের ওপারের আকাশকে দেখতে হয়। বাতাসের ওপারের বাতাসকে ছুঁতে হয়। বর্তমানের উপকার করে ভবিষ্যতের ক্ষতি চাই না। এটা কোন রাষ্ট্র বা সরকারও চাইবেন না। বঙ্গবন্ধুও চাননি। চাইলে তো তাঁকে জেলখানায় সংসার পাততে হতো না।

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads