• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সরকারের পরিকল্পনাগুলোতে অংশগ্রহণ করা দরকার

  • প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারি ২০২১

রাইসুল ইসলাম আসাদ

 

 

 

রাইসুল ইসলাম আসাদ, গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়েই অভিনেতা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন নাটকে রাইসুল ইসলাম আসাদ এক অপরিহার্য নাম। কিন্তু তারও আগে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যে পরিচয়ের ভেতরে রয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর বাঙালিসত্তার বিজয়গাথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরের পক্ষ থেকে এই গুণী ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেন পত্রিকার সহকারী সম্পাদক মামুন মুস্তাফা ও সহ-সম্পাদক অর্বাক আদিত্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতা প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

 

প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযুদ্ধে কেন জড়ালেন বা কীভাবে জড়ালেন?

উত্তর : এই প্রশ্নটার উত্তর আসলে নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। তবে কীভাবে যুক্ত হয়েছি এ ব্যাপারে একটু কথা বলা যেতে পারে। আমি তখন ছিলাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। আমি বাচ্চু (নাট্য নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ) ভাইসহ তিনজন আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে তো তখন বহু মানুষ চলে এসেছে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে। কেউ কেউ মধ্যবয়স্ক, কেউ তরুণ। কী তেজ তাদের! আমরা ভাবলাম আমরাও প্রশিক্ষণ নেব। আমরা প্রশিক্ষণ নিলাম একটা গেরিলা দলের সঙ্গে। আমরা এসেছিলাম প্রথমে ৫২ জনের একটা টিম। পরে ট্রেনিং হয়েছিল প্রথমে ২১ জনের। এটা হচ্ছে পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের দিকে একটা ক্যাম্প ছিল সেখানে। যখন আমাদের ট্রেনিং শেষ হয় তখন সেক্টর ভাগ হয়ে যায়। ঢাকা পড়ে যাই ২ নম্বর সেক্টরে। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাম্প ছিল মেলাঘরে। আমরা যেহেতু ঢাকার তাই আমাদের ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাম্পে চলে আসতে হলো পশ্চিম দিনাজপুর থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেই সময় আমাদের বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। অস্ত্র নেওয়ার জন্য তাদের কাছে একটা ট্রেনিং নিতে বলা হয়েছিল, সেই বিষয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত সেই ট্রেনিং নিইনি। এরপর আমরা ঢাকা উত্তর দল হিসেবে দেশে ইন করেছি। একসাথে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা আমরা বাংলাদেশে ঢুকেছিলাম। আমাদের দলে একজন স্কাউট ছিল। আমরা তার পেছনে পিঁপড়ের সারির মতো চলছিলাম, অন্ধকারে। ট্রেনিং, খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে আমরা সবাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম; তার ওপর আমরা বেডিং, গোলাবারুদ, গ্রেনেড, মাইন নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল, হাঁটা যাচ্ছিল না, তার ভেতরেই আমরা এগিয়ে চলছিলাম। মূলত মনোবলটা ছিল। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। আমাদের ট্রেনিং কমান্ডার মেজর ঝা বলেছিলেন, তোমরা কতটুকু শিখেছ আমি জানতে চাই না, তবে তোমাদের ভেতর মনোবল তৈরি হয়েছে, তোমরা বিজয়ী হবেই। আমাদের ঢাকার মেইন ক্যাম্প ছিল মানিকগঞ্জে। ৫২ জন টোটাল এসেছিলাম।

প্রশ্ন : আপনার বিশেষ কোনো অপারেশনের কথা যদি বলতেন? আর একটা বিষয়, শহীদ রুমির সাথে কি আপনার দেখা হয়েছিল?

উত্তর : সব অপারেশনই ছিল বিশেষ। একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেদিন আমার সাথে ছিলেন মেসবাহ সাবু ভাই, প্রচণ্ড সাহসী মানুষ। আমরা নদীপথে নৌকায় করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মুভ করতাম। তো ব্রিজের কাছে রাজাকার, পাকিস্তানি বাহিনী পাহারা দিত। আমরা রাজাকারদের ভেতরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তারা আমাদের সিগন্যাল দিত, তারপর আমরা পার হতাম। সেদিন ওখানে রাজাকাররা ছিল না। হানাদার বাহিনীর কাছে খবর ছিল এদিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যায়। তো তারা খুব দ্রুত এসে রাজাকারদের সরিয়ে দিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। আমরা একসাথে অনেক নৌকা যাত্রা করেছিলাম। আমাদের আগেরটা ঠিক মতোই পার হয়ে গিয়েছিল। আমরা যখন ব্রিজের নিচে ঢুকলাম, মনে আছে কেয়ামত শুরু হলো যেন, গোলাগুলি, ট্রিগার। আমি কিছু কূলকিনারা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলাম। যখন ভেসে উঠলাম দেখছি কিছু নেই। তারপর হাতড়াতে হাতড়াতে নৌকোর মতো কিছু একটা পাই, সেটিতে উঠে দেখি ওটা আমাদেরই নৌকা। সেখানে সাবু ভাই চিত হয়ে শুয়ে আছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনি এই অবস্থায়? তখন তিনি বলেছিলেন ট্রেনিংয়ে বলেছিল না যে বুলেট তোমার নামে তৈরি হয়নি, সেটি তোমাকে আহত করবে না। সাঁতার জানি না, তাই শুয়ে আছি। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা শরণার্থী শিবিরে।

না, রুমির সাথে দেখা হয়নি। গেরিলাদের একজনের সঙ্গে আর একজনের পরিচয় ছিল না, একদলের সাথে আরেক দলেরও না। যদি কারো পরিচয় ঘটত তখন তাকে ট্রান্সফার করা হতো।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ’৭৫ পর্যন্ত যে রাজনীতি সেটিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

উত্তর : একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশার ভেতর অনেকটা গোলমেলে অবস্থা ছিল। সেটিকে বঙ্গবন্ধু সামলিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তৎপর ছিল। একজন মানুষ তো একাই এতটা সংগ্রাম করতে পারে না। আলটিমেটলি সবাই চলে গিয়েছিল বিপক্ষে। সাধারণ যোদ্ধারাও। ধরুন, একজন কৃষক যিনি পাকিস্তাান বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যুদ্ধে গেল, সমস্তটা দিয়ে যুদ্ধ করল। সেই যোদ্ধা যখন দেখল দেশ স্বাধীন হয়েছে, তিনি ভাবতে শুরু করলেন এখন তার খাদ্য দেবে রাষ্ট্র, তার থাকা-খাওয়া মৌলিক অধিকার মেটাবে রাষ্ট্র। কিন্তু তার জন্য তো আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে। তিনি করলেন কি, কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ভোগের রাজত্ব করতে চাইলেন। এই যে মানুষের সীমাহীন চাওয়া, এই চাওয়ার জন্য কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আর যেটি বিষয় বাকশাল, বাকশাল তো সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে গঠিত। এখানে বুদ্ধিজীবীরা ছিল, চিন্তকরা ছিল। এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কেউ বুঝতে পারল না। তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হলো এবং আমরা পরিণতি দেখলাম পঁচাত্তরে এসে। মূলত যে প্রেতাত্মার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, যুদ্ধ, সেই প্রেতাত্মারাই জেঁকে বসল বাংলাদেশের ঘাড়ের ওপর। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে।  

প্রশ্ন : ’৭৫-পরবর্তী ’৯০ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছিল। সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারী শাসনের মধ্য দিয়ে যেটি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল—এই সময়টাকে আমরা কীভাবে দেখতে পারি? এই সময়টা মানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছরের সঙ্গে কোনো মিল আছে কি?

উত্তর : অবশ্যই শতভাগ মিল আছে। আমরা পাকিস্তানের যে ২৪ বছর, সেখানে তারপরও একটা আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর ছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বৈরশাসনে বা সামরিক শাসনে কিছুই তো বলতে পারিনি। দেশটাকে তারা অনেক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই মিলে দেশটাকে গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী ঘটল? জিয়াউর রহমান, এরপর এরশাদ একটা জঘন্যতম ইতিহাসের জন্ম দিল। মানুষের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিল। ইতিহাস বিকৃত করল। এই সময়টা আমাদের একশ বছরেরও অধিক পিছিয়ে দিয়েছে। রাজনীতিকে নষ্ট করেছে। সমাজ, শিল্প, সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে। আমি বলি কি, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে নষ্ট করেছেন, আর এরশাদ সমাজব্যবস্থাকে নষ্ট করেছেন।

প্রশ্ন : স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে দুটো বড় মুভমেন্ট হয়েছে—একটি স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, অন্যটি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। এই মুভমেন্ট দুটোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন  করেন?

উত্তর : মুভমেন্ট দুটো খুবই ইতিবাচক হিসেবে সংঘটিত হয়েছে। ’৯০-এ মানুষ চেয়েছিল পরিবর্তন। স্বৈরাচার যে চরম পর্যায়ে গিয়েছিল তার থেকে রেহাই পেতে। সেখানে দলমত নির্বিশেষে সবাই এসে আন্দোলন করেছে। কিন্তু তারপর কি ঘটল, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এলো বিএনপি। যে প্রত্যাশা ছিল সেই প্রত্যাশা পরিপূর্ণভাবে আসেনি। তবে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় মুভমেন্ট।

আবার ২০১৩-তে গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চাইল। এটি যখন শাহবাগে শুরু হয়, চতুর্দিক থেকে মানুষ এসে যুক্ত হলো। কাউকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মানুষ আসলে চাচ্ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। মৌলবাদকে মানুষ ‘না’ করে দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় পৌঁছেছে, তার একটা ইঙ্গিত। তবে এই মুভমেন্টটা আরো অনেক কিছু দিতে পারত। শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থানে আসতে পারল না।

প্রশ্ন : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে রাজনীতি করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রমোট করেছে। অনেকে মনে করছে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগও ঠিক একই কাজটি করছে। হেফাজতে ইসলামকে নানাভাবে প্রমোট করে। যার কারণে আমরা দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে পর্যন্ত তারা কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই ব্যাপারটা আসলে কী? আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা একটু জানতে চাই আপনার কাছে।

উত্তর : এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন আর কদিন পরেই। খোলাসা হয়ে যাবে। মৌলবাদিতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা কখনো আপস করবেন না। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেই বাংলাদেশই প্রতিষ্ঠা পাবে।

প্রশ্ন : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে কি মূল্যায়নের সময় এসেছে? আমাদের অর্জন-ব্যর্থতা কোথায়?

উত্তর : না, এখনো সময় আসেনি। আপাতত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিকল্পনাগুলো সরকার হাতে নিয়েছে, সেগুলোতে অংশগ্রহণ করা দরকার। মূল্যায়ন করা যেত; কিন্তু বাংলাদেশ চেতনার যে বিপক্ষ শক্তি, তারা তো দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। এই যে গ্যাপ এটা তো পূরণ করা দরকার।

প্রশ্ন : আমাদের আগামীর পদক্ষেপ কী হওয়া দরকার?

উত্তর : বোধ হয় আবারো যুদ্ধ করার সময় এসেছে। কথাটি বলছি যে কারণে, তা আপনারা খোলা চোখে দেখলেই বুঝতে পারবেন।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের খবরের পক্ষ থেকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

উত্তর : আপনাদেরও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads