• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বৈষম্য নিরসনে কাজ করতে হবে

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ২৭ জানুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে না কি অর্থ বৃদ্ধি পাচ্ছে? বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের পাহাড় যত বড় হচ্ছে এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে সামনে এনে ততই জোরালো হচ্ছে। বাংলাদেশের বয়স অর্ধশতাব্দী হয়েছে। স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেটা অর্থনৈতিক সাম্য, উন্নয়নের সাম্য, শিক্ষার সাম্য তথা এই সাম্য বিষয়টিই ছিল সামগ্রিক অর্থে। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে সাম্যের মন্ত্র ও স্বপ্ন ততোই বুড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে আয়বৈষম্যের পাহাড় ক্রমে হিমালয়ের আকার ধারণ করছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। নাগরিকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের, শিক্ষা-চিকিৎসা, সেবাপ্রাপ্তির অধিকার, সামাজিক সম্মানের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে, গ্রাম-শহরের মধ্যে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। সংবিধানে বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছে তা কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়। সেটা সামগ্রিক ক্ষেত্রে বৈষম্য। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পঞ্চশ বছরে পৌঁছে সাম্যের হিসাব আবার নতুন করে মিলিয়ে বছরের শুরু থেকেই বৈষম্যের পাহাড় সরানোর কাজটি শুরু করতে হবে।

আমাদের দেশে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ‘সাম্য’ শব্দটি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি রয়েছে। বৃহৎ একটি অংশ সাম্য বলতে কেবল অর্থনৈতিক সাম্যকেই বুঝে থাকে। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা সাম্য শব্দটির অর্থ ও প্রয়োগ সামগ্রিক অর্থে বুঝেন এবং সেটা বাস্তবায়নের দাবি করেন। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সমাজস্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সাম্য বলতে বুঝেন অর্থনৈতিক সাম্য। নাগরিকদের পাঁটি মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও যে সাম্যের বিষয়টি জড়িত সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। বলতে গেলে ‘সাম্য’ শব্দটির বুঝাপড়ায় সেই হিসাবই টানেন না। যার ফলে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়নি সেই আলোচনার আড়ালে মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতে সাম্যের আলাপ সামনে আসছে না। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য যেমন রোধ করা যাচ্ছে না তেমনি অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপ হচ্ছে না। ক্রমে এই জটিলতা আরো বাড়ছে। তাই সাম্য প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের পাহাড় সরানোর আলাপে অর্থনীতির বাইরেও অন্য সব ক্ষেত্রে বৈষম্যরোধ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে আনা উচিত। এবং এই দিকগুলোর উপরেও জোর দেয়া উচিত। বাংলাদেশে বোঝাপড়ার দিকে থেকে বৈষম্যের তালিকায় নাগরিকদের চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা সংক্রান্ত বৈষম্যও অনুপস্থিত। বরং এই বিষয়গুলো অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেয়েও অনেক মারাত্মক। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য তার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক প্রভাব ও সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্য। তাই আমরা যখন কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলি তখন আলোচনাটা একপেশে হয়ে যায়।

অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সব ধরনের বৈষম্য নিরোধ করতে হলে আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র পরিচালনার পলিসিতে বৈষম্য রোধের পন্থা গ্রহণ করা। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে সমাজতন্ত্র, যা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বীকৃত একটি ‘দর্শন’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক পলিসিতে। যার ফলে সেই থেকে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়তে বাড়তে হিমালয় পর্বতসম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য এতো পরিমাণ হয়েছে যে, ক্ষুদ্র একটা শ্রেণির হাতে বিপুল সম্পত্তি জমা হয়েছে। অপরদিকে জনসংখ্যার বৃহৎ একটা অংশ ক্রমেই দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্রতে পরিণত হয়েছে। কোন দেশে অর্থনীতিতে বৈষম্য কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটার পরিমাপক হচ্ছে জিনি সহগ পদ্ধতি। একটি দেশের অর্থনীতির জিনি সহগ যখন ০.৫ এর কাছাকাছি কিংবা সেটাকে অতিক্রম তখন সে দেশকে বলা হয় চরম আয়বৈষম্যের দেশ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল ০.৩৩; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে ২০১৬ সালে খানা আয় ও ব্যয় জরিপ হিসাবে সেটা বেড়ে ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ‘ওয়াল্ট আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮’ এ বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি-ধনী বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বের এক নম্বর দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই পাঁচ বছরে দেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে মাত্র ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্যগোষ্ঠীর হাতে ব্যাপক সম্পদ জমা হয়েছে। ২০১০ সালে দরিদ্র ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় ছিল জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা হ্রাস পেয়ে ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে ১০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় ছিল জিডিপি’র ২ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা হ্রাস পেয়ে ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। অপরদিকে ২০১০ সালে ১০ শতাংশ ধনাঢ্যের হাতে সম্পত্তি ছিল জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০১০ সালে অতি-ধনীশ্রেণির হাতে সম্পদ ছিল জিডিপি’র ২৪.৬১ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৮৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এই যে গুটিকতক মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সর্বক্ষেত্রে। শিক্ষা, চিকিৎসা, রাজনীতি, প্রশাসন সব ক্ষেত্রেই এই শ্রেণির আধিপত্য বাড়ছে। অপরদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো ক্রমে প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন চরম বৈষম্য বিরাজ করছে তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই দুই অঞ্চলের মধ্যেও আন্তবৈষম্য রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে শহরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা শ্রেণি হচ্ছে ভাসমান জনগোষ্ঠী। যাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শিক্ষার সুযোগ, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই। অন্যদিকে শহরের বস্তিঅঞ্চলে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বাস করে। তাদের বাস করার মতো একটি ঘর বা জায়গা থাকলেও তাদের অন্যান্য নাগরিক অধিকারগুলো খুবই দুষ্প্রাপ্য। ফলে একই শহরে বাস করেও তাদের মধ্যে বৈষম্য আকাশ-পাতাল। অন্যদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যের বৈষম্য রয়েছে। তবে সেটা শহরের মতো প্রকট নয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ শহরের তুলনায় অনেক কম। বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিকে ভর্তির হার সরকারি হিসাবে ৯৮ শতাংশ। কিন্তু এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো অক্ষরই চেনে না। পাঠ্যবই পড়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। অন্যদিকে গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বেতনভাতাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তুলনায় বৈষম্যের শিকার। চিকিৎসা ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজমান। লিটারেচার রিভিউয়ের তথ্য বলছে, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। শীর্ষ ২০ শতাংশ পরিবারে শিশুর জ্বর, ডায়রিয়া বা শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় তিনগুণ বেশি চিকিৎসা সহায়তা পেয়ে থাকে। অসুস্থ শিশুদের মধ্যে কেবল ৩৭ শতাংশ শিশু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে চিকিৎসা নেয়, এর মধ্যে দরিদ্র ও মেয়ে শিশুদের সংখ্যা কম।

উপরোক্ত বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে নাগরিকদের জীবনমানের সামগ্রিক দিক থেকে বৈষম্য নিরসনের উপায় অন্বেষণ করতে হবে। তা না হলে সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন হবে না। বলতে গেলে স্বাধীনতার স্বপ্নই বাস্তবায়ন হবে না।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads