• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় শিক্ষাস্তর—এক

  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রফেসর ড. আবদুল খালেক

 

 

 

দেশের জনগণকে জাতীয় কর্মে ও উন্নয়নে গঠনমূলক অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষিত করে তুলতে হলে বঙ্গবন্ধু একটি সর্বজনীন শিক্ষাপদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, পাঁচ বছর মেয়াদের প্রাইমারি শিক্ষা দায়িত্বশীল নাগরিক ও উন্নত ব্যক্তি গঠনের জন্য যথোপযুক্ত নয়। তা ছাড়া পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও তত্ত্ব সম্পর্কে বালক-বালিকাদের মনে ধারণা ও বোধশক্তি জাগ্রত করার এবং অর্থকরী বিদ্যার প্রাথমিক বিষয়গুলো তাদের শিক্ষা দেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায় না। আট বছরের কম মেয়াদি স্কুল শিক্ষায় এসব উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব নয়। সুনাগরিকত্ব অর্জনের জন্য এই আট বছরের শিক্ষা অত্যাবশ্যক। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে প্রসার হচ্ছে তাতে শিক্ষায়তনে কমপক্ষে আট বছর মেয়াদের একটি জীবন্ত ও বাস্তব পরিবেশভিত্তিক সুপরিকল্পিত শিক্ষাক্রম চালু না করতে পারলে সে শিক্ষাকে দেশের অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়াররূপে কাজে লাগানো যাবে না। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে ৮ থেকে ১২ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনাকে কুদরত-ই-খুদা কমিশনে বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। এই কমিশনে প্রস্তাব করা হয়েছিল—প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষারূপে পরিগণিত করে তাকে সর্বজনীন করতে হবে এবং প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যে অবৈতনিক শিক্ষা চালু রয়েছে, তা ১৯৮০ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এরপর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রবর্তন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু  প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

সম্প্রতি Secret Document of Intelligence of Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সে গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ৪৮ সালের ১ জুন নরসিংদীতে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।’ এ থেকে প্রমাণিত হয় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে তিনি অনেক আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করেছেন। তিনি মনে করতেন, গরিব মানুষ শিক্ষার আলো পেলে তারা জেগে উঠবে এবং দেশ উন্নত হবে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ৯-১০ ধরনের প্রাইমারি শিক্ষা আছে। এত ধরন তো থাকতে পারে না। এটা এক বা দুই ধরনের হওয়া উচিত।’

 

মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

আমরা জানি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা কাঠামোর দ্বিতীয় স্তর। মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে কুদরাত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্টে। কমিটির রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে-

1.    নবম থেকে একাদশ/দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত শিক্ষা হবে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা। নবম/একাদশ/দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের যোগসূত্র বজায় রাখা ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় সমতা নিশ্চিত করার জন্য একই শিক্ষায় এনে এই তিন/চারটি শ্রেণির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।

2.    মাধ্যমিক স্তুরের শিক্ষা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রান্তিক শিক্ষা এবং স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে বিবেচিত হবে। এ উদ্দেশ্যে নবম শ্রেণি হতে শিক্ষা মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে— বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা। বৃত্তিমূলক শিক্ষা মোটামুটি তিন বছর মেয়াদি (নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণি) হবে। সাধারণ শিক্ষা চার বছর মেয়াদি (নবম, দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) থাকবে। এই বিশেষ প্রশিক্ষণ দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের চাহিদা এবং কর্মপ্রদান সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনানুযায়ী নির্ণীত হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রাপ্ত সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা দুরূহ কাজ। সে ক্ষেত্রে এদের অনেকেই নিজের উদ্যোগে স্বনির্ভর হয়ে কর্মসংস্থান করে নেবে।

প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের রূপরেখাও বঙ্গবন্ধু দিয়ে রেখেছিলেন যেমন— (ক) একাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক স্কুল সম্পর্কে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে দেশের কিছুসংখ্যক শিক্ষায়তনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলুক। পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক প্রমাণিত হলে দ্বিতীয় জাতীয় পঞ্চবার্ষিকীর পরিকল্পনায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার ক্রম রূপায়ণের কার্যক্রম স্থির করা যাবে, এ ক্ষেত্রে প্রথম ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ হবে তিন বছর এবং মাস্টার ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ হবে দুবছর।

 

মাদরাসা শিক্ষা ও টোল শিক্ষা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন মাদরাসা শিক্ষাকে আমূল সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা হোক। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মাদরাসাগুলোতে একই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হবে এবং সর্বস্তরে বাংলাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা আবশ্যিক পাঠ্য বিষয় হিসেবে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষায় মাদরাসার ছাত্ররা তিন বছর মেয়াদী বৃত্তিমূলক ধর্ম শিক্ষা কোর্স পড়তে পারবে। এ কোর্সের নবম ও দশম শ্রেণিতে তাদেরকে বাংলা, গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইংরেজি এই চারটি আবশ্যিক পাঠ্য বিষয় অধ্যয়ন করতে হবে। এই শিক্ষার পরবর্তী স্তরবিন্যাস হবে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং দুবছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স।

প্রস্তাবিত আট শ্রেণির প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে হিন্দু ও বৌদ্ধ টোল শিক্ষার সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। টোলসমূহের আদ্য কোর্স সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু না করে নবম শ্রেণি থেকে শুরু করতে হবে এবং তার মেয়াদ হবে তিন বছর। এ কোর্সে নবম ও দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা অন্যদের মতোই ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে আবশ্যিক চারটি বিষয় বাংলা, গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইংরেজি পাঠ করবে।

 

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

আধুনিক সমাজের অগ্রগতি উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি ও মানের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কারণ উচ্চশিক্ষার ভূমিকা হচ্ছে— ক. বিভিন্ন উচ্চতর কাজের জন্য সুনিপুণ জ্ঞান এবং দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি তৈরি করা; খ. এমন শিক্ষিতগোষ্ঠী সৃষ্টি করা, যাদের কর্মানুরাগ, জ্ঞানস্পৃহা, চিন্তার স্বাধীনতা, ন্যায়বোধ ও মানবিক মূল্যবোধ সম্যক বিকশিত হয়েছে; গ. গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের নবদিগন্ত উন্মোচন করা এবং ঘ. সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলির বিশ্লেষণ ও সমাধানের পন্থা নির্দেশ করা।

বঙ্গবন্ধুর গঠিত কুদরত-ই-খুদা কমিশন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার বর্তমান পদ্ধতি নানা দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ। সমাজের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগসূত্রহীন এ শিক্ষা সমাজের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা সরকারি চাকরি লাভের ছাড়পত্র মাত্র।  প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না করেই নতুন নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং চালু কলেজগুলোর সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অপরিকল্পিত এরূপ সম্প্রসারণ কাজের ফল হয়েছে শিক্ষার উন্নতমান অর্জনের পরিবর্তে শিক্ষার মানের গুরুতর অবনতি। জাতির ভাগ্য ও জাতির অর্থনীতির সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় শিক্ষিত জনসম্পদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে অবশ্যই সুসমন্বিত করতে হবে। আমাদের জীবনে অর্থনীতির তাৎপর্য বিপুল। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জাতির অন্যতম লক্ষ্য। সুতরাং সমাজের সর্বস্তরের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যাতে সুনির্বাচন হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

পাকিস্তান আমলে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে পড়ানো হতো, তা থেকে বঙ্গবন্ধুর গঠিত কুদরত-ই-খুদা রিপোর্টে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। পাস কোর্সে, অনার্স কোর্সে এবং মাস্টার্স কোর্সের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। যে সমস্ত কলেজে অনার্স কোর্স রাখা হয়, সেগুলো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পাস কোর্সের কলেজগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আধুনিক উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য খুলনায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার উচ্চস্তর পর্যন্ত বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়। কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, আইন, ললিতকলা অর্থাৎ শিক্ষার যাবতীয় শাখা নিয়ে কুদরত-ই-খুদা কমিশন অত্যন্ত গঠনমূলক সুপারিশ প্রদান করে। সে সুপারিশসমূহ তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আমলের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে প্রকৃত অর্থেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, আর তাই তিনি সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত দেশের চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, যথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য Presidential order 1973 জারি করেন, যা পরবর্তীকালে সংসদে পাস হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি এখনো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর উচ্চশিক্ষা ভাবনা ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারে স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তচিন্তা বিকাশের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার উৎকর্ষ সাধন এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আর্থিক চাহিদা নির্ধারণ।

স্বাধীনতার পর সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অত্যন্ত উদারভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু সে সব দেশের সাথে প্রটোকল সই করেন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তখন বৃত্তি নিয়ে পূর্ব ইউরোপের সেসব দেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যায়। ১৯৭২ সালে শুরু হয়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই পড়তে যায় এক হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে। আজকের বাংলাদেশের বহু প্রথিতযশা শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, গবেষক সেদিনের বঙ্গবন্ধুর সেই সুদূরপ্রসারী ভাবনার সোনালি ফসল। সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রশাসন, রাজনীতি এমনকি কূটনীতিতেও তাদের অনেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।

বিদেশে পড়াশোনা করে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থেকে যাবে, এমনটি বঙ্গবন্ধু চাইতেন না। তিনি চাইতেন সবাই দেশে ফিরে আসবে, দেশের জন্য কাজ করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে প্রতি বছর কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বৃত্তি নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন বিদেশে যেত বঙ্গবন্ধু তখন তাদের ডেকে কথা বলতেন এবং উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, ‘তোরা সোনার ছেলে হয়ে দেশে ফিরবি, সোনার বাংলা গড়বি।’

উচ্চশিক্ষার মান খারাপ হোক, বঙ্গবন্ধু তা চাননি। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন দেশের প্রখ্যাত গবেষক, কথাসাহিত্যিক জনাব আবুল ফজল মহোদয়কে। তার সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর বিএ পরীক্ষার ফলাফল ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সম্ভবত পাসের হার ছিল ৩%। এ জন্য উপাচার্য মহোদয়ের বিরুদ্ধে নানারকম আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত উপাচার্যের অপসারণ দাবি করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এ থেকে বোঝা যায় একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য়ের মান-মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কতটা সচেষ্ট ছিলেন।

 

বৃত্তিমূলক শিক্ষা

বঙ্গবন্ধু মনে করতেন বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষ সাধন ব্যতীত কোনো জাতি কৃষি, শিল্পকারখানা এবং অন্যান্য উৎপাদন ও কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করতে পারে না। বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার লাভের দ্বারা জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব। বৃত্তিমূলক শিক্ষা তুলনামূলকভাবে অল্প সময় সাপেক্ষ এবং সে জন্য অল্পকালের ভেতরেই এর সুফল লাভ করা যায়।

কারিগরি শিক্ষাকে সুসংহত করার জন্য দেশের সমস্ত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীনে আনতে হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রম থেকে উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সমবায়ের ভিত্তিতে ছোট ছোট কারখানা বা খামার ইত্যাদি গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে তাদের কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধানের কথা ভেবেছিলেন। কৃষির উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা স্তরের কৃষি কারিগরি কোর্স চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads