• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে স্যার শামসুজ্জোহা

  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আরিফুল ইসলাম

 

 

 

জন্ম-মৃত্যুর মাঝের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ের ওপর নির্ভর করে মৃত্যুর পর সেই মানুষকে পৃথিবী কতদিন মনে রাখবে! তবে তা ভালোবাসার নাকি ঘৃণার তা নির্ভর করে ব্যক্তির কর্মের ওপর ।

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১ মে ১৯৩৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হয়। সেই সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণে করেন। ১৯৬১ সালে জোহা স্যার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের ১ মে থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে এসে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ববাংলায় আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি বাহিনী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে হত্যা করে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিহত হন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক। এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করলে ড. জোহা ছাত্রদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন এবং আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি শিক্ষক সভায় বলেন, ‘আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে যেন আমার গায়ে লাগে।’

ওইদিন রাতে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেছিলেন, ‘শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।’

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। তখন পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা মুখোমুখি অবস্থানে। ড. জোহা একদিকে ছাত্রদের শান্ত করছিলেন, অন্যদিকে সেনা কর্মকর্তাদের বোঝাচ্ছিলেন আর বার বার বলছিলেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে।’ একপর্যায়ে ছাত্রদের বোঝাতে সক্ষম হন, ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করেন। পরিস্থিতি যখন শান্ত, ঠিক তখনই গুলির শব্দ। ড. জোহাকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। দীর্ঘ সময় পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তিনি নিজের জীবন দিয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, যার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের দাবানল সারা দেশে ত্বরিতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং দেশ স্বাধীন হয়। জোহা স্যার একদিকে ভাষা সৈনিক, একজন আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবক, গবেষক, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।

তিনি যে একজন আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবক ছিলেন তার প্রমাণ দিয়েছেন নিজের জীবনের বিনিময়ে ছাত্রদের জীবন বাঁচানোর মাধ্যমে। প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়স্থ তার সমাধিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে ‘জোহা চত্বর’, তার নামে নামকরণ করা হয় একটি ছাত্র হলেরও। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এবং এর বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছি। কারণ জোহা স্যারের আত্মত্যাগ শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে যা খুবই দুঃখজনক।

‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এর পর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রদের গায়ে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ জোহা স্যারের এই অমর বাণী যখনই পড়ি তখনই শরীর শিউরে ওঠে। মনের মধ্যে প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস বৃদ্ধি পায়। আমি মনে করি, জোহা স্যারের আদর্শ সম্পর্কে সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জানা উচিত। ড. জোহা যুগে যুগে শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয় ও আদর্শ।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads