• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

বিশেষ সাক্ষাৎকার : মলয় ভৌমিক

একটা সাংস্কৃতিক সামাজিক বিপ্লব দরকার

  • প্রকাশিত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মলয় ভৌমিক। অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাপ্তি-প্রত্যাশা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র কলাভবনে ‘বাংলাদেশের খবরে’র সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন দেশের এই বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা। ‘পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের খবরের এই বিশেষ আয়োজনে তাঁর সেই আলাপন সাক্ষাৎকারের আলোকে তুলে ধরেছেন পত্রিকার সহ-সম্পাদক অর্বাক আদিত্য ও লেখক নাজমুল হাসান।

 

বাংলাদেশের খবর : আপনারা যারা যুদ্ধে গেলেন, সরল রেখায় দেখলেও তাদের একটা স্বপ্ন ছিল। এই স্বপ্নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কীভাবে জড়িয়ে গেলেন?

 

মলয় ভৌমিক : বাংলাদেশের খবরটা আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও তাৎপর্যটা অনেক বড়। মুক্তিযুদ্ধ তো হঠাৎ কিছু লোকের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা নয়। আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার যে বিকাশ সেখানে দেখলেও দেখা যাবে যে— এর একটা সাংস্কৃতিক পটভূমি ছিল। দেখবো— একটা ভাষাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়া; সেটাও কিন্তু শাসকদের চেয়ে জনসাধারণই বেশি করেছে। মধ্যযুগের চণ্ডিদাস, আবদুল হাকিম নিজেদের ভাবনা জানিয়েছেন। এসবের ভেতর নানা লোকগাথা যেমন আছে তেমনি বীরত্বগাথাও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে সময়ে আমাদের সামনে স্বপ্নের নেতা হিসেবে দাঁড়ালেন, তিনিও তো এক দিনেই দাঁড়াননি। তার আগে আমাদের এই ভূখণ্ডে কত বড় বড় মানুষ; কত বড় বড় কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে সেগুলোও তো প্রভাবিত করেছে। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা ঘটেছে, ধাপে ধাপে। আমরা তারুণ্যে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, সেখানে আবেগটা ছিল আমাদের। আর, কৌশলটা ছিল বঙ্গবন্ধুর। শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধটা হতো না। যুদ্ধে আমাদের আবেগ, ভালোবাসা ও সাহস ছিল, কিন্তু এই দুটো জিনিস থাকলেই কি যুদ্ধ করা যায়? যুদ্ধের অতীত লাগে, আবার বর্তমান যুদ্ধের কৌশলটাও লাগে। সেজন্যেই নেতৃত্বের একটা বড় ভূমিকা তৈরি হয়। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর মতো ত্যাগী আদর্শবাদী নেতা যদি না পেতাম, তাহলে আমাদের যে সফলতা সেটি অর্জন করতে পারতাম না। আমরা তাকে কোনো অন্ধভক্তি করিনি। তবে, সেই সময়েই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি বাঙালি, বাংলাদেশ; এবং আপামর জনগণকে কতটা ভালোবাসেন। সেটা তিনি পঁচাত্তরে জীবন দিয়েও প্রমাণ করে গেছেন। নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নির্মোহ থাকা; তার এই গুণগুলো আমাদের আকৃষ্ট করেছিল।

 

বাংলাদেশের খবর : আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তারা একটা প্রজন্ম ছিলেন। সেই সূত্র ধরেই বলি— আজকের প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন? তাদের পক্ষে কী আরেকটা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া সম্ভব?

 

মলয় ভৌমিক : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, সামাজিক নানা ধরনের অনাচার-অন্ধত্বের মধ্য দিয়ে, অবিজ্ঞানমনস্কতার মধ্য দিয়ে, সংস্কৃতিহীনতার মধ্য দিয়ে, নিও মিডিয়ার যে প্রভাব জায়গা করে নিয়েছে তাতে করে আজ তাদের পক্ষে একাত্তরের মতো মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়তো সম্ভব নয়।

 

বাংলাদেশের খবর : আর একজন বঙ্গবন্ধু এলে কি পারবেন?

 

মলয় ভৌমিক : না, এখানে বাংলাদেশের খবরটা তা নয়। শুধু নেতৃত্ব দিয়ে তো হয় না। সময়টা খুব জরুরি। বঙ্গবন্ধুর মতো ক্যারিশমা নিয়েও যদি কেউ দাঁড়ান তারপরও হবে না, ব্যাপারটা একপক্ষে ঘটে না। দ্বিপাক্ষিক প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে।

 

বাংলাদেশের খবর : এখন আপনার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আসি। আাাপনি তো সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন। স্রেফ ইতিহাস নয়। স্মৃতিচারণও নয়। বিশেষ কোনো সাহস, প্রতিবন্ধকতার ঘটনা যদি বলতেন?

 

মলয় ভৌমিক : বাংলাদেশের খবরটা যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাহলে এভাবেই বলি। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কানসেনা গ্রামে। আমার গ্রামে আমরা একটা পরিবারই ছিলাম ‘মাইনর’। আমাদের গ্রামে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আটজনই আগে চলে গিয়েছিলেন, আমাকে তারা নেননি। একাত্তর সালে সবচেয়ে বেশি টার্গেট করা হয়েছে মাইনরিটিকে। কাজেই তারা ভাবলো, তাদের যাওয়া আর আমার যাওয়া এক না। এটি খুবই পজিটিভ। মুক্তিযোদ্ধারা ভালো বাসছে মানুষকেও। কেবল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়, আমার পরিবার যাতে নিরাপদ থাকে সেদিকেও তারা সচেতন। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারি তৃতীয় বারের বার। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন যে আমাদের বাড়িতেই বড় হয়েছে। যুদ্ধের সময় সে একদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে এসে শুয়েছে। ভোরে উঠে দেখি আমাকে না নিয়েই তারা চলে গেছে। আমি বের হয়ে আমার এক বন্ধুর দেখা পাই। তার নাম বুদ্ধু— সে আমাকে বলে, তারা তো এদিকেই বেরিয়ে গেল। আমি তিন কিলোমিটার দৌড়ে তাদের ধরেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ তো কেবল রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করা নয়। মানুষকে রক্ষা করাও। তারা যে আমাকে বাদ দিতে চেয়েছিল, এটি বিরাট একটি অভিজ্ঞতা, নেগেটিভ অর্থে নয়। এটিকে পজিটিভলি দেখি। আর একটি কথা— কেউ যেতে চাইলে তাকে কেউ আটকাতে পারে না। সেই তাগাদা থেকেই গেছি। আমি যে দলে গেলাম, সেই দলের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন রায়গঞ্জের একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় ও স্কুলশিক্ষিক আলী আশরাফ। তিনি ঠান্ডা মাথার লোক। তিনি প্রথমেই আমাকে গ্রহণ করলেন এবং বললেন, আজ থেকে তোমার নাম হবে শফিক। প্রথমে ভাবলাম, এটিও তো খুব সাম্প্রদায়িক চিন্তা! তারপর একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন আমার নাম শফিক? তিনি যে উত্তর দিলেন সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বললেন, দেখো তোমার সত্য নাম উচ্চারণ হলে, তোমার বাবা, মা, পরিবার সবাই আক্রান্ত হবে। তাই নাম বদলানো দরকার।

 

ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক অঘটনও ঘটেছে। শেষের দিকে আমরা ভাবলাম গ্রামে যাবো। চলে এলাম। খোঁজ করছি— কারা রাজাকার। কিন্তু মানুষ প্রথমে আঙুল তুললো চোরদের দিকে। তার মধ্যে একজন ছিল গণি চোর। তাকে রাত বারোটার সময় আমরা উঠিয়ে নিয়ে আসি এবং বাজার যাওয়ার পথে স্টেনগান দিয়ে গুলি করা হয়। উদ্দেশ্য— মানুষ দেখবে, চোরের শাস্তি। এই ব্যাপারটি তখন ভাবায়নি। কিন্তু ছয় মাস যেতেই ভাবলাম, আমরা এতো বড় একটা ভুল করেছি। এই ভুলটা পরবর্তী জীবনে আমাদের অনেক করণীয় ঠিক করে দিয়েছে। আমরা গণি চোররে মারলাম কিন্তু অনেক চোর তো থেকেই গেল। যারা প্রকৃতই চোর। অস্ত্র জমা না দিয়ে সেই অস্ত্র ব্যবহার করে ডাকাতি করেছে। ব্যাংক লুট করেছে। আমরা ব্রিজ অপারেশনেও ছিলাম। রাজারপুরে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছি। ভাটফিয়ারি ক্যাম্পে যুদ্ধ করতে যাবো, সেখানে গিয়ে শুনলাম, একজন মুক্তিযোদ্ধা এক নারীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। তখন আমাদের প্রধান ছিলেন মোজাম্মেল ভাই। তিনি ফাঁকা মাঠে নিয়ে গিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেদম মারতে লাগলেন। অজ্ঞানের মতো হয়ে গেল। যখন শাস্তিটা হয়ে গেল— তারপর নিজেই ডাক্তারকে বলে ট্রিটমেন্ট করান। এই ব্যাপারগুলো আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।

 

আমাদের মাঝে মধ্যেই না খেয়ে থাকতে হতো। ক্ষুধায় কান্না পেতো। সেবার শমসেতপুরে গেলাম। সেখানে ভোর ছয়টায় রটে গেল মিলিটারিরা আসছে। সত্যি এসেও ছিল। তারা ফায়ার ওপেন করেছে। তারপর আমরাও ফায়ার ওপেন করেছি। এলাকার লোকজন ছুটে পালিয়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, আর্মিদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছি। এসব করতে করতে আমাদের ক্ষুধা প্রচণ্ড হয়ে গেল। আমরা তিনজন মানুষের বাড়িতে মুড়িচিড়া খুঁজছি। এ সময় দেখা গেল একটা বাড়িতে টেবিলে ডাল, আলুভর্তা, লালচালের ভাত সাজানো। তখনো ধোঁয়া উড়ছে। হয়তো খেতে বসবে এমন সময় বেরিয়ে গেছে। আমরা খেতে বসলাম। ওদিকে যুদ্ধ চলছে। টিন ফুটো করে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ তখন যেন খেলার মাঠ হয়ে গেছে! ক্ষুধার কাছে হার মানছে। এই ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে।

 

আরেকবার, একজায়গায় অপারেশন করতে গেলাম। সেখানে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমরা যদি গুলি করতাম অনেক লোক মারা যেত। একজন মাইনরিটি (ফণী দা) অভিযোগ করলো— একজন তার জমিজমা দখল করে নিয়েছে। রাজাকার হিশেবে যায়নি। কিন্তু প্রভাবশালী লোক। আমরা তার কাছে গেলাম। বললাম সব ফেরত দিয়ে দেন অথবা তাকে টাকা দেন। লোকটা সব স্বীকার করলেন। বললেন, আপনারা অপেক্ষা করেন টাকা দিচ্ছি। তারপর বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে বাঁশঝাড়ে গিয়ে ডাকাত ডাকাত বলে চিল্লাতে লাগলেন। ধর, ধর, বলে অনেক লোক বেরিয়ে এসেছে। আমরা বেগতিক দেখে ফাঁকা ফায়ার করে চলে এলাম। আমরা গুলি করতে পারিনি, করলে অনেক লোক মারা পড়তো। এই ফাঁকে অপরাধীও বেঁচে গেল।

 

বাংলাদেশের খবর : স্বাধীনতা বলতে তো সামগ্রিক একটা মুক্তি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি। আপনার বহুমাত্রিক পরিচয় আছে, তার মধ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে পরিচয় সেটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সেই জায়গা থেকে— আপনারা যারা যুদ্ধে গেলেন, সেখানে সাংস্কৃতিক উপরিতলটা কেমন ছিল? বা স্বাধীন দেশে কী রকম সাংস্কৃতিক-পরিবেশ প্রত্যাশিত ছিল?

 

মলয় ভৌমিক : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার মনে হয়— সেই সময় এই জায়গাগুলো নিয়ে আমরা ভাবিনি। যার ফল এখন পাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি ভাবা উচিত ছিল শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি নিয়ে। ‘কুদরত-ই-খুদা’ কমিশনের একটা শিক্ষানীতি পেয়েছিলাম, কিন্তু ’৭৫-এর ঘটনা তো উল্টোদিকে মোড় নিলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনেক কিছু হয়। সবকিছু একবারে দাঁড়ায় না। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায়। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। ’৭৫-এর পরে শিক্ষার ভেতর পাকিস্তানি মনোভাবটাই মূর্ত হয়ে উঠলো। সাম্প্রদায়িক চিন্তা চলে এলো। ইতোমধ্যে আমাদের একমুখী যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেটি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিভক্ত হয়ে গেল। অনেক সিলেবাস রচিত হলো। আবার, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন, সেখানে পুঁজিবাদ চলে এলো। ব্যাপারটা এমন— একটার সাথে আরেকটার কোলাজ ঘটলো। শিক্ষার ভেতর কতোটা বিজ্ঞানচিন্তা আছে, কতোটা যুক্তিবাদী চিন্তা আছে, এগুলোর দিকে তাকানো হয়নি। শিক্ষা হয়েছে বাণিজ্যমুখী, পরীক্ষামুখী। জ্ঞানমুখী নয়।

 

সামাজিক মনোভাবটাও এভাবেই গড়ে উঠেছে। আজকের নতুন প্রজন্ম সাঁতার শেখেনি, সূর্যোদয় দেখেনি, প্রকৃতি চেনেনি, ভোরের পাখির ডাক শোনেনি— এরা তো প্রকৃতির ভেতর বেড়ে ওঠেনি। কোনো সমস্যা নিজে সমাধান করেনি। একটা প্যাকেজের মতো করে তাদের বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আগে প্রতি বছর গ্রামে দুটি তিনটি নাটক হতো, যাত্রাপালা হতো, অনেকের বাড়িতে দোতারা ছিল, হারমোনিয়াম ছিল। অন্তত শরৎচন্দ্রের বই ছিল। রাতের বেলা পুঁথিপাঠ হতো। এই উপাদানগুলো কোথায় চলে গেল?

 

আরেকটা ব্যাপার— আশির দশক থেকে একটা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়েছে। কীভাবে হলো— নিম্নবিত্ত মানুষের দুই বিঘা জমি ছিল। বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেল। সেখানে থালাবাসন মেজে বা চাকর বাকরের কাজ করে কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে জমিজায়গা কিনলো। সম্পদের দিক থেকে সেই পরিবারগুলো মধ্যবিত্ত হয়ে গেল। কিন্তু সংস্কৃতিচর্চাটা অধরাই থেকে গেল।

 

বাংলাদেশের খবর : আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কেমন দেখছেন?

 

মলয় ভৌমিক : এখনকার রাজনীতিতে আদর্শ বলে কিছু আছে? সবটাই ব্যবসায়ীরা দখল করে নিয়েছে। রাজনীতিতে এখন মাপা হয় কাকে নমিনেশন দেবো? ও তো ভালো মানুষ, ভোটে জিততে পারবে না। মানুষকেও নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আজকে দেখুন, কথা উঠলে আপনি যদি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, মানুষ বলবে লোকটা বিএনপি করে আবার বিএনপির সমালোচনা করলে বলবে লোকটা আওয়ামী লীগ করে। এর বাইরে চিন্তা করতে পারে না। অথবা, হয়ে গেছে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ, কোনো তৃতীয় পক্ষ কি দাঁড়ালো? আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যারাই ক্ষমতায় যাবে তারাই অজনপ্রিয় হবে। নাই নাইয়ের দেশে মানুষের ভেতর যে ক্ষোভ জন্মে— সেই ক্ষোভকে অবজারভ করার জন্য তৃতীয় একটা শক্তি মাঠে থাকা চাই। আমাদের এখানে বামরা যে একত্রিত হয়েছিল, তারাও সেই স্বপ্নটা দেখাতে পারেনি। সর্বত্র একটা ভোগের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিকগুলো এক প্রকার নষ্ট হয়ে গেছে। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের ভেতর থেকে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপার। যখন জার্নিটাই করতে হচ্ছে নষ্ট নর্দমার ভেতর দিয়ে তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যে সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা সেটি আর থাকে না। নানাদিক থেকে আমরা হতাশার ভেতর আছি।

 

এই জায়গাগুলো নিয়ে আমরা ওভাবে ভাবিনি। কিন্তু ভাবার দরকার ছিল। রাজনীতি যারা করেন তারা ব্যবসা নিয়ে ভাবেন। এসব বিষয় নিয়ে ভাববার তাদের সময় কোথায়! (দীর্ঘশ্বাস) আজকে আরেকটা দিক লক্ষ করবেন— সরকারের ওপর যে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব তৈরি হয়েছে, সেটি খুবই নেতিবাচক। আমলারা সার্ভেন্ট অব দ্যা পিপল। কিন্তু তারা হয়ে গেছে জমিদার-বাদশা। যেমন কখনো সামরিক শাসন সুফল বয়ে আনতে পারে না, আমলাতান্ত্রিকতাও সুফল বয়ে আনবে না। কিংবা, একটা ভয়ের সংস্কৃতি। সবদিক থেকে আমরা একটা খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি। এখান থেকে যদি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা না করি, সেটি কঠিন। কয়টা স্লোগান দিলাম আর বিজয় দিবসে গিয়ে বেদিতে ফুল দিলাম- তা দিয়ে দেশপ্রেম হয় না।

 

বাংলাদেশের খবর : যুদ্ধ, স্বাধীনতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি কিংবা হতাশা; একটা নিরন্তর জার্নির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ৫০ বছরে পৌঁছেছে। এখন এই মহূর্তে দাঁড়িয়ে আগামীর স্বপ্নটা আসলে কীভাবে দেখতে চান? কিংবা, দেখা যায়?

 

মলয় ভৌমিক : আমি যদি এই হতাশার জায়গাটা আশার দিকে নিয়ে যাই; তবে সেখানে কিন্তু একটা স্বস্তি আছে। এই জার্নির ভেতর দীর্ঘ একটা লড়াই আছে। যদি আশার কথা বা আবারো স্বপ্নের কথায় আসতে হয়— তবে আমি মনে করি প্রথমে হাত দেওয়া দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়। এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। আইনের কথায় বলবো— বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যেতে হবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। আসলে মূল কাজটা তো রাজনৈতিক। একটু পেছনে ফিরি। আমরা যারা সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করি— মুক্ত নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম ’৮৪ সালের দিকে। গ্রামে গ্রামে লাগাতার কর্মসূচি ছিল। মামুনুর রশীদ, আমি, মান্নান হীরা; অনেকেই। ওই সময় আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সাহায্য পাইনি। তবে আমরা দেখেছি— এই সাংস্কৃতিক কাজটাও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাটাকেও ঢেলে সাজানো দরকার। সরকার কাদেরকে কোথায় বসাবেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যারা ফাইল নিয়ে তোয়াজ করছে তাদেরকে যদি সেই জায়গায় বসায়; তবে পরিবর্তন আসবে না। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে যে বদনাম তৈরি হয়েছে, তার কারণটা কী? সিস্টেমটা সরকার পাল্টাতে চায়নি। চেয়েছে, যারা গিয়ে তোয়াজ করবে তাদেরকেই বসাবে। কাজেই যারা তাদের কাছে গিয়ে তোয়াজ করেছে, তারাই জায়গাগুলো পেয়েছে। পরে যখন তাদের বদনাম হচ্ছে, সরকার তাদের ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু সিস্টেমটাকে বদলাচ্ছে না। সিস্টেমে হাত না দিয়ে উপরি উপরি কতগুলো ব্যবস্থা নিলে তো হবে না। আমি মনে করি— এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এখনই এই কাজগুলো করা উচিত। আজকে যখন জাতির পিতার ভাস্কর্য কিংবা বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে, তখন আর চুপ থাকার কোনো মানেই হয় না। তারা তো রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে, সংবিধানের ওপর হস্তক্ষেপ করছে— এখনই কি সময় নয় তাদের নিষিদ্ধ করার? পজিটিভ একটা জায়গা মানুষের আছে। কিছু জাগরণ হয়েছে। যেখানে দল মত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ যুক্ত হয়েছিল— এই পজিটিভ জায়গাগুলো কেন সরকার কাজে লাগাচ্ছে না? আমার মনে হয়, রাজনৈতিক শক্তি বোধহয় দেশের নীতিনির্ধারণী জায়গায় কাজ করছে না! নীতিনির্ধারণী জায়গায় রাজনৈতিক শক্তিকে আনতে হবে। আমলারা নন, ব্যবসায়ীরা নন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নন— রাজনীতিবিদদের চিন্তাটা করতে হবে। আর দরকার সামাজিক জাগরণ। সেখানে অবস্থা তো আরো ভয়াবহ, আমরা কেবল ‘আমি’ বলতে শিখেছি, ‘আমরা’ বলা ভুলে গেছি। স্বার্থপর হয়ে উঠেছি, পরার্থপর হইনি। আগে নায়ক সেই হতো— যে সবার জন্য কিছু করতে পারে। আর, এখন সে-ই নায়ক— যে একার জন্য কিছু করতে পারছে।

 

বাংলাদেশের খবর : তারপরও স্বপ্নটা তো রয়ে যায়।

 

মলয় ভৌমিক : হ্যাঁ। আমরা একটা স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। এখনো মানুষের কথা, দেশের কথা ভাবি। আমাদের যে প্রজন্ম— সেটা তো আমরাই তৈরি করেছি। সুতরাং, দায় তো আমাদেরও। এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে, চট করে দোষ অন্যের ঘাড়ে দেওয়া, আইন পাল্টাও। কিন্তু প্রয়োজন নিজের করণীয়টা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একটা সাংস্কৃতিক সামাজিক বিপ্লব দরকার। তবে এটি বলতেই হয়— যে জায়গায় এসে আমরা পৌঁছেছি; এখন ‘কেঁচোগণ্ডুশ’ করতে হবে। অর্থাৎ, নতুন করে শুরু করতে হবে। এই সমাজ নিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই না। জেগে দেখতে চাই। জেগে স্বপ্ন দেখতে হলে মাথা থাকা চাই। আমাদের মাথা নষ্ট পচে গেছে। নতুন মাথা দরকার; সেটিকেই বলছি ‘কেঁচোগণ্ডুশ’। নতুন করে শুরু করতে হবে সবকিছু।

বাংলাদেশের খবর : আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

 

মলয় ভৌমিক : ধন্যবাদ আপনাদেরকে, বাংলাদেশের খবরকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads