• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সাক্ষাৎকার

ভারতীয় পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতা জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা

  • প্রকাশিত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন

 

 

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন একটি আলোচিত নাম। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোার আগেই হাঁটতে শুরু করেছিলেন রাজনীতির পথে। এই অশীতিপর বয়সেও সে চলার বিরাম নেই। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ হলেও রাজনীতিতে এখনো সক্রিয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে কারাবরণ করে তার কারাজীবনের শুরু। জীবনের বিশ বছর তার কেটেছে কারান্তরালে। ১৯৭০ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রেখেছেন অসামান্য অবদান। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, মন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

শাহ্ মেয়াজ্জেম হোসেনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১০ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি গ্রামে। আইনজীবী, রাজনীতিক শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন লেখালেখিতেও সিদ্ধহস্ত। তার ‘নিত্য কারাগারে’, ‘ছাব্বিশ সেল’, ‘বিচলনে’, ‘বলেছি বলছি বলব’ পাঠক সমাজের প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের খবরের পক্ষ থেকে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম বাংলাদেশের সাত দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের জীবন্ত সাক্ষী শাহ্্ মোয়াজ্জেম হোসেনের। বাংলাদেশের খবরের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন

 

বাংলাদেশের খবর : আপনি তো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সক্রিয় সংগঠক। আপনারাই এ দেশটিকে মুক্ত করেছেন। আজ সে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে আপনার অনুভূতির কথা যদি বলতেন?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : প্রথমেই আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনকে, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের ফসল আমাদের এই স্বাধীনতা। আমি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, যার নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আমি প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে অভিবাদন জানাই, যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এ দেশকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন।

স্বাধীনতা অর্জনের এবং তার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের সাক্ষী হওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। আমি আল্লাহ গফুরুর রহিমের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে এ পরম সৌভাগ্যদান করেছেন। আমার অনেক সহযোদ্ধা আজ দুনিয়াতে নেই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বাংলাদেশের খবর : যে লক্ষ্য নিয়ে সেদিন আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তা পূর্ণতা পেয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : এ এক কঠিন প্রশ্ন করলে তুমি। আমি যদি এক কথায় বলি স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তাহলে তা অপূর্ণাঙ্গ কথা হবে। আবার এটাও বলতে পারব না স্বাধীনতার স্বপ্ন একেবারেই পূরণ হয়নি। প্রথমত আমাদের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট এ দেশটিকে পশ্চিমা শাসক-শোষকগোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছি। তবে দেশের স্বাধীনতা এলেও জনগণের মুক্তি, আমি অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছি, তা পুরোপুরি আসেনি। শুধু একটি মানচিত্র বা পতাকার জন্য তো এ দেশের মানুষ এত ত্যাগ স্বীকার করেনি। সেইসাথে তাদের আরো অনেক স্বপ্ন ছিল। বলতে দ্বিধা নেই, তা সর্বাংশে পূরণ হয়নি।

বাংলাদেশের খবর : এ অপূর্ণতার দায় কাদের বলে আপনি মনে করেন?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : এককভাবে কারো ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সবারই দায় আছে। তবে আমরা যারা রাজনীতি করি তাদেরই দায় বেশি। কেননা আমরাই তাদের একটি স্বাধীন ও স্বাবলম্বী দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। সময়ে সময়ে আমাদের কিছু ভুল এবং সংকীর্ণতা স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের খবর : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনি তো বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠ শুধু নন, অত্যন্ত স্নেহভাজন ও বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। তার সঙ্গে আপনার পরিচয় কবে, কীভাবে হয়েছিল?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : সহচর নয়, আমি তার স্নেহধন্য কর্মী ছিলাম। তার সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ছাপ্পান্ন কি সাতান্ন সালে। ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন হচ্ছিল গোপালগঞ্জে। সেখানে আমাকে পাঠালেন শহিদউদ্দিন ইসকান্দার কচিভাই (নোয়াখালী)। সে সম্মেলনে বক্তৃতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবেই অনেক ওপরে তুলে ধরি। বলে রাখি, তখনো তিনি আমার দূর থেকে দেখা স্বপ্নের নায়ক। ঢাকায় ফেরার কয়েকদিন পর ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি  আবদুল মমিন তালুকদার আমাকে বললেন, মুজিবভাই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। তার সঙ্গে গেলাম মুজিবভাইয়ের বাসায়। তিনি তখন সেগুনবাগিচার একটি বাসায় থাকেন। আমি তার সামনে যেতেই বললেন, কী রে তুই নাকি গোপালগঞ্জের মানুষকে নাচিয়ে এসেছিস? বললাম, বাড়িয়ে কিছু বলিনি। যা সত্য তাই বলেছি। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, এখন থেকে সময় পেলেই আসবি। সেই শুরু। তারপর কত স্মৃতি, কত কথা!

বাংলাদেশের খবর : সেসব স্মৃতির দুয়েকটি আমাদেরকে বলবেন কী?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : সম্ভবত ১৯৬১ সাল। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি। একদিন মুজিবভাই (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি) আমাকে দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। গেলাম তার বাসায়। তিনি আমাকে কতগুলো ছাপানো কাগজ দিলেন। দেখলাম ‘পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্টের’ নামে একটি লিফলেট। বললেন, ‘এগুলো আজ রাতে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে দিতে পারবি? দেখ খুব রিস্কি কাজ, সাহস করস?’ আমি বললাম, ‘লিডার, আপনি তো জানেন, আল্লাহ আমাকে অনেক কিছুই কম দিয়েছেন। সবচেয়ে কম দিয়েছেন ভয়। আপনি হুকুম দিলে সব করতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে। ধরা পড়লে কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত। এক কাজ কর—পাঁচজনকে বাছাই করে নেমে পড়। রাতের মধ্যে সব কয়টা এম্বেসির গেটের ভেতরে ফেলে আসবি।

আমি চারজনকে সাথে নিলাম। শেখ ফজলুল হক মণি, কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান ও আনিস। পাঁচজন সাইকেলে ঘুরে ঘুরে সব এম্বেসি ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেটা ফেলে দিয়ে এলাম। পরদিন সে কী হইচই! ওই লিফলেটেই সর্বপ্রথম পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছিল।

বাংলাদেশের খবর : আপনি তো জীবনে বহুবার জেলে গেছেন। অনেকে আপনাকে জেলের পাখি বলত। বঙ্গবন্ধুও অনেকবার জেলে গেছেন। জেলখানায় কি তার সাথে আপনার দেখা হয়নি?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তার সাথে জেলখানায় দেখা হওয়ার কথা আমার ‘নিত্য কারাগারে’ বইতেও উল্লেখ করেছি।

বাংলাদেশের খবর : জেলখানার কোনো স্মৃতি?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : একটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে। প্রায় তেরো মাস আমরা একসাথে জেলে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু দেওয়ানিতে আর আমি ২০ নম্বর সেলে। তিনি প্রায়ই গল্প করার জন্য আমাকে ডেকে নিতেন। বেশিরভাগ দিন তার ওখানেই দুপুরের খাবার খেতাম। একদিন খাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বিছানায় শুয়ে আছেন, আমি মেঝেতে। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাস? বললাম, জেলওয়ালারা যা দেয়, সকালে রুটি, দুপুরে আর রাতে ভাত। তিনি বললেন, আর কিছু খাস না? খাইতে মন চায় না? বললাম—পাইলে খাই, না পাইলে না খাই।

ওইদিনই সন্ধ্যায় এক কারারক্ষী এসে আমাকে দুই কার্টুন ক্যাপস্টান সিগারেট দিয়ে গেল। বলল, নেতা দিয়েছেন। শেষ হলে আমাকে বলবেন। আমার চোখ দিয়ে জল এসে গেল। এই তো নেতা! কর্মীর প্রতিটি চাহিদার বিষয়ে যিনি নজর রাখেন তিনিই তো নেতা। আমরা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সিগারেট ভাগাভাগি করে খেতাম। বাসা থেকে কোনো ভালো খাবার এলে তিনি আমাকে না দিয়ে খেতেন না। জীবনে তো অনেক মানুষের স্নেহ পেয়েছি। তবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ আমার জীবনের পরম পাওয়া।

বাংলাদেশের খবর : এবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা বলুন।

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : দেখো, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অনিবার্য পরিণতি। আমরা যখন বুঝতে পারলাম শোষিত হচ্ছি, আমরা রুখে দাঁড়ালাম। কেননা আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা ছিলাম পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ, আর ওরা ছিল ৪৪ শতাংশ। অথচ জাতীয় বাজেটের ৮৭ শতাংশ যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। তার মানে ১০০ প্লেট রান্না হলে যেখানে আমাদের পাবার কথা ৫৬ প্লেট, সেখানে আমাদের দেওয়া হচ্ছিল ১৩ প্লেট। আর ওরা ৪৪ জনে খায় ৮৭ প্লেট! এ বঞ্চনা থেকেই দ্রোহের উৎপত্তি। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। কী করে আমরা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে এবং তারই সিঁড়ি বেয়ে কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম তার ইতিহাস সবাই জানে।

বাংলাদেশের খবর : ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি তো আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার কিছুটা বলবেন কি?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই আমরা সিগন্যাল পেয়ে যাই কী হতে যাচ্ছে এবং আমাদের কী করতে হবে। তারপরও একটা সমাধান খুঁজে বের করার জন্য বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে যাচ্ছিলেন। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য। প্রতিদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসায় যাই। তাকে গাড়িতে তুলে দিই ইয়াহিয়ার বৈঠকে যাবার জন্য। সন্ধ্যায় তিনি ফিরে এলে যাই অগ্রগতি জানার জন্য। তিনি খোলাসা করে কিছু বলতেন না। শুধু বলতেন—ধৈর্য ধর। শেষ দিন, মানে ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় আলোচনা থেকে ফিরে আসার পর যখন জিজ্ঞেস করলাম—লিডার খবর কী? তিনি আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, যা, বিক্রমপুর গিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নে। পাশে ছিল ওবায়েদ। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা ফরিদপুরে গিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নে। আমি বললাম, কী দিয়া যুদ্ধ করব? আমাদের কাছে তো একটা ‘সেভেন ও-ক্লক ব্লেড’ও নাই। বঙ্গবন্ধু বললেন, যার যা আছে তাই নিয়ে রেডি হ।

বাংলাদেশের খবর : তারপর?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করব, কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর নাই। কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নাই। ঢাকার অবস্থা তখন নরকতুল্য। ২৭ মার্চ কোনোরকমে ঢাকা থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ীতে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওদিকে পাক হানাদাররা আমার গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা কয়েকজন আগরতলার উদ্দেশে রওনা হলাম। অনেক কষ্টে পৌঁছলাম আগরতলা। আমার স্ত্রী এবং এক বছর বয়সি শিশুপুত্রটির কোনো ব্যবস্থাও করে যেতে পারলাম না। সেখান থেকে পৌঁছলাম কলকাতা। সেখানে গিয়ে সবাইকে পেলাম। মাস দুয়েক পরে আমার মামা আবুল বাসার হাওলাদার ও আওয়ামী লীগ কর্মী মোস্তফা কামাল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার স্ত্রী-পুত্রকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।

বাংলাদেশের খবর : কলকাতায় আপনাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : আমাকে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সিনিয়ররা বললেন, ও সদ্য ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে এসেছে। ও-ই বুঝবে কাকে নেওয়া যায়। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান তার অফিসটি আমাদের ছেড়ে দিলেন। তিনি চলে গেলেন ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে; যেটাকে বলা হতো বাংলাদেশের রাজধানী। আমরা যে বাড়িটিতে বসতে শুরু করলাম, সেটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ি। আমাকে বলা হলো, যাকে উপযুক্ত মনে হবে, তাকে একটি স্লিপ দিয়ে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতে। ট্রেন ভাড়া লাগবে না। আর আমার খাওয়ার জন্য দেওয়া হতো এক রুপি।

বাংলাদেশের খবর : ওই সময়ের বিশেষ কোনো স্মৃতি আছে কি, যা আজো আপনাকে তাড়িত করে?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : একজনের কথা খুব মনে পড়ে। আগেই বলেছি আমার দুপুরের খাবারে বরাদ্দ ছিল এক রুপি। এটা সে সময়ে একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমি খেতে যাওয়ার সময় আরো দু-চারজন সঙ্গী হতো। বাজেট ওই এক রুপি। বাধ্য হয়ে উল্টোদিকের একটি কম দামি খাবার হোটেলে যেতাম। মালিক বিহারি মুসলমান। কেউ একজন একদিন বলে দিল আমি বাংলাদেশের এমপি এবং যুদ্ধ করতে এসেছি। বিহারি ভদ্রলোক তার কর্মচারীদের বলে দিলেন—গোশতের সঙ্গে ঝোল বেশি করে দিতে, যাতে তার মধ্যে তন্দুরি রুটি ভিজিয়ে খেতে পারি। কোনো কোনো দিন তিনি আমাকে বিনে পয়সায় চাও খাওয়াতেন। আমি অবাক হতাম। দেশে বিহারিরা আমাদের শত্রু জ্ঞান করে। আর ইনি কী পরম বন্ধুর মতো আচরণ করছেন। তার কথা এখনো আমার মনে পড়ে।

বাংলাদেশের খবর : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য আপনি ভারতে অনেক সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে ভারতীয় পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে সম্বন্ধে যদি কিছু বলতেন-

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : সে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা! আমার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গৌরবের ঘটনা। আমাদের সরকার সিদ্ধান্ত নিল, দিল্লিতে একটি শক্তিশালী পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল পাঠাবে। তাদের কাজ হবে দিল্লি পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে লবিং করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্বদ্ধে তাদেরকে অবগত করা, সমর্থন আদায় করা। প্রতিনিধিদলের নেতা নির্বাচন করা হলো শ্রী ফণীভূষণ মজুমদারকে, সদস্য নূরজাহান মুর্শেদ ও আমি। থিয়েটার রোডে আমাদের ডেকে ব্রিফ করা হলো। নির্দিষ্ট দিনে আমরা দিল্লি পৌঁছলাম। পালাম বিমানবন্দরে নামতেই একজন কেতাদুরস্ত লোক এসে জানতে চাইল আমরা বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি টিমের সদস্য কি না। পরিচয় পেয়ে তিনি আমাদের দিল্লিস্থ পশ্চিমবঙ্গ হাউসে নিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন এমপি এলেন এবং তারা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। তাদের মধ্যে সোসালিস্ট পার্টির নেতা এমপি সমর গুহ পরিচয়মুহূর্ত থেকেই আমার দাদা হয়ে গেলেন। তিনি আমাদের দিল্লির পার্লামেন্ট ভবনে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি অনেক পার্লামেন্ট সদস্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরদিন দিল্লির পত্রিকায় আমাদের আগমনের খবর ছবিসহ প্রকাশিত হলো। অনেকেই পশ্চিমবঙ্গ হাউসে ভিড় করলেন। পরদিনও আমরা পার্লামেন্টে গেলাম। সেখানে পরিচয় হলো ভারতের প্রবীণ রাজনীতিক রাজনারায়ণের সাথে। দেখা হলো আরেক প্রভাবশালী নেতা জগজীবন রামের সঙ্গে। তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখা হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস দলীয় এমপি মিসেস পূরবী মুখার্জির সঙ্গে। তার সঙ্গে বাতচিতের পর পরই আমি তার ছোট ভাইয়ের জায়গাটি দখল করে নিলাম। সমর গুহ তাকে বললেন, ‘এরা তো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তো বিরোধী দলের লোক। এ কাজটি আপনি করলে ভালো হবে।’ পূরবীদি সানন্দে রাজি হলেন এবং ওইদিনই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে পরদিন আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দিল্লিস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের অন্যতম কর্মকর্তা কূটনীতিক শাহাবুদ্দীন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে তখন কাজ শুরু করে দিয়েছেন। একই সময়ে আরো একজন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান হাইকমিশনের কলকাতাস্থ তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার মো. হোসেন আলী।

পরদিন সকাল এগারোটায় পার্লামেন্ট হাউসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গেলাম ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। দরজার সামনে এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। আমরা অভিভূত। ফণীদা তাকে ধন্যবাদ জানালেন আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। এখানে বলে রাখি, ফণীভূষণ মজুমদার ভারতের প্রবীণ রাজনীতিকদের কাছে অত্যন্ত সম্মানীয় ছিলেন। কারণ তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর একান্ত সচিব হিসেবে এক সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীও তাকে খুব সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। তিনি আমাদের সবকথা শুনলেন এবং জানালেন, সবকিছুই তিনি জানেন। আমি প্রায় এক কোটি লোককে আশ্রয় দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গ তুললাম। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ওটা ঠিক সময়ে হয়ে যাবে। এ সময়ে পূরবী মুখার্জিও একই দাবি করলেন। ইন্দিরা গান্ধী হেসে বললেন, আমি তো জানতাম বাংলাদেশ থেকে তিনজন এসেছেন, এখন তো দেখছি চারজন! সবাই হেসে উঠলাম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী নিজহাতে তার কক্ষে সাজিয়ে রাখা বয়ম থেকে আমাদের আচার খেতে দিলেন। তারপর বললেন, আপনারা পার্লামেন্টের একটি বৈঠকে আপনাদের বক্তব্য তুলে ধরুন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এ ব্যাপারে পূরবী মুখার্জিকে তিনি দায়িত্ব দিলেন।

নির্ধারিত তারিখে আমরা হাজির হলাম ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনে। দেখলাম লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। ভারতীয় লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন আমাদের স্বাগত জানালেন। আগেই পরিচয় হয়েছিল লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত তরুণ সদস্য ও ভারতীয় যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সির সঙ্গে। সমবয়সি হওয়ায় আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। যাহোক, অধিবেশন শুরু হলো। স্পিকার জি এস ধীলন আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বক্তব্যের জন্য আহ্বান জানালেন। প্রথমেই বক্তব্য রাখলেন ফণীভূষণ মজুমদার, তারপর নূরজাহান মুর্শেদ। সবশেষে আমি। বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে আমি আবেগাপ্লুত হলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েও নিজের দেশের সংসদে বক্তৃতা করতে পারলাম না। আজ অন্য দেশের পার্লামেন্টে জীবনের প্রথম সংসদীয় বক্তৃতা করতে হচ্ছে! দুঃখ এবং আনন্দের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণে আমার মনে বিচিত্র এক অনুভূতি কাজ করছিল। সেদিন আমার কথার জোয়ার যেন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। আমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর নির্মম ও পৈশাচিক নির্যাতনের বর্ণনা এমনভাবে করলাম, উপস্থিত সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। আমি বললাম, আমি জানি না আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্রটি কোথায় কী অবস্থায় আছে। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তাও জানি না। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তারা গুলি খেয়ে মারা যাক, তবুও যেন ওই বর্বর বাহিনীর হাতে ধরা না পড়ে। বললাম, আমার মতো অবস্থা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি স্বামী ও পিতার। আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান। বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে আমাদের সাহায্য করুন। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা ইংরেজিতে সেদিন বক্তৃতা করেছিলাম। আমার বক্তৃতার সময় অনেকেই চোখ মুছছিলেন। কেউ কেউ শব্দ করে কাঁদছিলেন। বক্তৃতা শেষ করে যখন নামলাম, তখন আমাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল। স্পিকার ধীলন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই করমর্দন-আলিঙ্গনে আমাকে সিক্ত করলেন। বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রবীণ জননেতা বিজু পাটনায়েক আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বেটা, তুম নে কামাল কর দিয়া।’ জীবনে অসংখ্য বক্তৃতা করেছি। কিন্তু ভারতীয় পার্লামেন্টের ওই বক্তৃতা আমার জীবনের সর্বশেষ্ঠ বক্তৃতা।

বাংলাদেশের খবর : আপনি তো বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার চরিত্রের কোন দিকটি আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করত?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদী নেতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি, কারো কাছে মাথা নত করেননি। নীতি এবং দেশ ও জাতির স্বার্থের প্রশ্নে তার আপসহীনতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভেবে দেখার বিষয়, যে ভারত আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে বিশাল ভূমিকা রাখল, সঙ্গত কারণেই আমরা ভারতের জনগণ ও সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু যখনই সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এলো, বঙ্গবন্ধু আপস করেননি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার দেশ থেকে কবে আপনার সৈন্য ফিরিয়ে আনবেন? ইন্দিরা গান্ধী তাতে এতটুকু অসন্তুষ্ট হননি। বরং হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘আপ যব চাহিয়ে।’ দুর্দিনে সাহায্যকারীর মুখের ওপর এমন সাহসী কথা সবাই বলতে পারে না। তারপর ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যাওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেট কলিগদের কেউ কেউ ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ বিশেষ কোনো বন্ধু দেশের অসস্তুষ্ট হওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনড়। তিনি সেই ওআইসিতে গিয়েছিলেন। নীতির প্রশ্নে তার এ দৃঢ়তা আমাকে তার দিকে চৌম্বকশক্তিতে আকৃষ্ট করেছিল।

বাংলাদেশের খবর : স্বাধীনতার পরে আমরা অর্ধশতাব্দী পার করছি। এখনো স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কাউকে কাউকে বিতর্কের প্রয়াস পেতে দেখা যায়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক শুধু দুঃখজনকই নয়, যারা এটা করে তারা আমার বিচারে অর্বাচীন। আমাদের স্বাধীনতার মূল নিউক্লিয়াস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে ঘিরেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আগে-পরে তিনি এ বিষয়ে আমাদেরকে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন স্বাধীনতার কথা। হ্যাঁ, এটা ঠিক, এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তিনি দিয়ে যেতে পারেননি। পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। তার ৭ মার্চের ভাষণের ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে’ বাক্যটি কি যথেষ্ট নয়, তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন তা বোঝার জন্য? এটাও অস্বীকার করার জো নেই, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়া (পরে রাষ্ট্রপতি) স্বাধীনতাযুদ্ধের আহ্বানটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধে তারও অবদান আছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলতে চাইবে তারা জ্ঞানপাপী। আর জিয়ার অবদানকে যারা অস্বীকার করতে চাইবে তারা আমার দৃষ্টিতে কূপমণ্ডূক। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রভূত অবদানের জন্যই বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানকে বীর-উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন। সুতরাং আমি মনে করি স্বাধীনতার ঘোষক কে তা নিয়ে অযথা বিতর্ক গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশের খবর : কেউ কেউ অভিযোগ করেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও গণতন্ত্র পূর্ণতা পায়নি। আপনার মন্তব্য কী?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই, সে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা আমরা এখনো পাইনি। এর পেছনে নানা কারণ আছে। এই অল্প পরিসরে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলব, আমরা যদি উদার হতে না পারি, তাহলে গণতন্ত্র সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।

বাংলাদেশের খবর : আপনার রাজনীতির শুরু বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। আজ তার বিপরীত আদর্শের রাজনীতির সাথে আপনি সম্পৃক্ত। আপনার মনে কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা আছে কি?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : সব কথা সব সময় বলা যায় না। বঙ্গবন্ধু যদি নিহত না হতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো। তিনি যখন বাকশাল করেন, আমি দ্বিমত করেছিলাম। বলেছিলাম, লিডার, আপনি চিরদিন ওয়েস্টার্ন ডেমোক্রেসির কথা বলে এসেছেন। এখন এ পদ্ধতিতে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাহলে তুই আমার বিপক্ষে চলে যা। আমি বলেছিলাম, লিডার আপনি যতদিন বেঁচে আছেন, আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তারপরের ইতিহাস বলতে চাই না। তার মৃত্যুর পরে আমরা টাকি ছাড়া পোনার মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আক্ষেপ নেই, একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। অবশ্যই আছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতি করে জীবন কাটিয়ে দিতে না পারার আক্ষেপ কি না থেকে পারে?

বাংলাদেশের খবর : বর্তমান সময়ের রাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : রাজনীতি বলতে আসলে যা বোঝায়, এখন কী তা আছে? রাজনীতির ঘরে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। সর্বত্র পচন ধরেছে। পরিষ্কার করে সব বলাও মুশকিল। অবস্থাটা হয়েছে—‘সত্যকথা বললে পোলায় মাইর খায়, আর না বললে স্বামী হারাম খায়’ প্রবাদের মতো। তাই বলব না...

বাংলাদেশের খবর : কিন্তু আপনি তো আপনার বই ‘বলেছি বলছি বলব’তে লিখেছেন—আপনি সত্য কথা আগেও বলেছেন, এখনো বলছেন, আগামীতেও বলবেন।

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : অপেক্ষায় থাকো। আল্লাহ যদি আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখেন, আর সুযোগ দেন, তাহলে আরো কিছু কথা নিশ্চয়ই বলব।

বাংলাদেশের খবর : আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলবেন?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : আমার একটাই আহ্বান থাকবে তাদের প্রতি, দেশটাকে ভালোবাসো। যে দেশ তোমাদের বাপ-চাচারা যুদ্ধ করে এনে দিয়ে গেছে, সে দেশটাকে রক্ষা করো। পড়াশোনা করো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।

বাংলাদেশের খবর : বর্তমান অবস্থায় আপনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা আশাবাদী?

শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : বর্তমান অবস্থার কথা যদি বলো, তাহলে বলব আমি হতাশার সাগরে ডুবে আছি। কী চেয়েছিলাম আর কী হচ্ছে! জানি না এই হতাশা নিয়েই আমাকে মরতে হয় কি না। তারপরও বলব, আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাবে। তারা নিশ্চয়ই দেশটাকে টেনে তুলবে।

বাংলাদেশের খবর : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন : তোমাকে এবং বাংলাদেশের খবরকে ধন্যবাদ এমন একটি মহতী উদ্যোগের জন্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads