• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের নারী

  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০২১

মো.ওসমান গনি

 

 

 

একজন মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা একটি অন্যতম। কারণ সুশিক্ষাই পারে কেবল একজন মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে। শিক্ষা ছাড়া একজন মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকার। তাই নারী ও পুরুষ সবার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে এমন এক সময় ছিল যখন নারীকে শিক্ষার বাইরে রাখা হতো। তখন পুরুষদের ধারণা ছিল, নারীরা সাংসারিক কাজকর্ম করবে, তাদের তেমন কোনো শিক্ষার প্রয়োজন নেই। তখন পুরুষ মানুষের মনে এ কথাটাও জানা ছিল না, পরিবারের মা শিক্ষিত হলে গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা যায়, যেটা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাই। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমাদের দেশে পুরুষদের চেয়ে নারীরাই শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে আছে।

শিক্ষাকে আমরা বিদ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান অনেক নামেই অভিহিত করতে পারি। দেশ ও সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া সমাজ তথা দেশ কোনোভাবেই উন্নয়নের মূল শিখরে পৌঁছতে পারবে না। সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক নানা কারণে এ দেশের দরিদ্র মানুষ যেমন বঞ্চিত হয়েছে, তেমনি সর্বস্তরে ব্যাপক সংখ্যক নারীও এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যর বেড়াজালে সর্বদা নারীকে ঘিরে রাখা হতো। নারীর শিক্ষাকে শুধু পরিবারের মঙ্গল, শিশু যত্ন ও ঘরকন্নার কাজে সীমাবদ্ধ রাখা এবং দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক এই শিক্ষিত নারীকে জাতীয় উন্নয়নে নিষ্ক্রিয় রাখার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রবণতা দূর করতে হবে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অসামান্য অবদান রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে নারী আত্মনির্ভরশীল জাতীয় উৎ‌পাদনে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হয়ে ওঠে। তাই নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সেই আলোকে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী করা, সমানাধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করা, সকল পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণে নারীকে সজাগ ও দক্ষ করা, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র্য বিমোচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়তা করা, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবার গঠনে উৎ‌সাহিত করা এবং যৌতুক ও নারী নির্যাতন রোধ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারেন, এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মপ্রত্যয় নারীর মধ্যে সৃষ্টি করা।

বর্তমান সরকার নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নে অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ১৫ পৃষ্ঠার ৯-১৩ উপ-ধারায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরি বিষয়াদি যথা— স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, তথ্য, উপার্জনের সুযোগ, সম্পদ, ঋণ, প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করা। আমাদের সংবিধানেই রয়েছে সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। সুতরাং সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য। দেশের জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধকেই শিক্ষানীতি তৈরি করার সময় প্রাধান্য দিতে হবে। নৈতিকতাহীন শিক্ষা, পরস্পরবিরোধী শিক্ষা, সহশিক্ষা, সেশনজটযুক্ত শিক্ষা পরিহার করে জীবন ও জগতের পরিচ্ছন্ন ধারণানুযায়ী উৎপাদনশীল ও কর্মমুখী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা জরুরি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যা প্রযোজ্য হতে পারে। এটা অবধারিত সত্য যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না। উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীর শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাদ্য কর্মসূচি রয়েছে। পৌরসভার বাইরে বিনাবেতনে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ আর মহানগরের বাইরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে। শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় নারী প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি পুনর্গঠন এবং প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, বেগম শহীদ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। বয়স্ক নারী শিক্ষা কার্যক্রমও চালু করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে এসব উদ্যোগ নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে।

নারী শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বেসরকারি পর্যায়েও রয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। মেয়েদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার বিশেষ বৃত্তি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, আয়মূলক প্রশিক্ষণের সঙ্গে শিক্ষা, নারীদের জন্য বিশেষ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই। সন্দেহ নেই, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নারী শিক্ষার হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তারপরও আর্থসামাজিক বেশকিছু সমস্যা রয়ে গেছে যা নারী শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নারীর উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আর্থসামাজিক বাধাগুলো দূর করা প্রয়োজন। সর্বোপরি সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে নারীর উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প কোনো পথ নেই। আমাদের দেশ ও সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করে পূর্বপুরুষদের সনাতন ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারীদের শিক্ষার ব্যপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমানুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা অর্ধেক। এই বিশাল নারী সমাজকে শিক্ষার বাইরে রেখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। দেশ-বিদেশে শিক্ষ, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের নারীদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। তিনি আজ রোল মডেল। সুতরাং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সকল সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের নারীদের আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করা উচিত। তবেই এ দেশের একুশ শতকের মেয়েদের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads