• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সুপ্রভাত বাংলাদেশ

  • মোস্তাফা কামাল মহীউদ্দীন
  • প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২১

আজ ২৬ মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ সুবর্ণ রেখায়। একসময় মড়া-ক্ষরা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও ঝড়-ঝঞ্ঝাপীড়িত জাতি হিসেবে খ্যাত বাঙালি আজ জাতিসংঘের ছাড়পত্র পেয়ে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সৌরভে-গৌরবে বাঙালি জাতি আজ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজ এই সূর্য সম্ভাবনাময় ক্ষণে আমরা স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সমসাময়িক বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনিই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলার। আজ আমাদের সব অর্জন, সব পথচলা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনালি ফসল।

‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ এটা কথার কথা বা ঐশী বাণী নয়, বরং আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বিদেশনীতির মূলমন্ত্র। এই বিশ্বাস আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকালে বিদেশনীতি প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ এই রাজনৈতিক দর্শন বর্তমান সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। অপর দেশগুলোর বিরোধ থেকে নিরাপদ দূরত্ব এবং নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার মতো দুরূহ কাজ আমাদের সরকার সাফল্যের সঙ্গে পালন করে চলেছে। সেই সঙ্গে শত উসকানির মুখেও আমরা বিরোধে জড়িত হওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পেরেছি।

এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রায় চার বছর আগে আমাদের নিকটপ্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। পূর্ব তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে প্রথমে আমাদের সরকার তাদের গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কিন্তু তাদের ওপর পরিচালিত অবর্ণনীয় জুলুম অত্যাচারের কাহিনী শোনার পর তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আমরা আশ্রয় না দিলে সাগরে সলিল সমাধি ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমরা নীতিগতভাবে কারো সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার বিরোধী। তবে অবিলম্বে  মিয়ানমারের এই অমানবিক কার্যকলাপের অবসান এবং রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন চাই। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধানে অকৃতকার্য হওয়ার পর বিষয়টি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশগুলো এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর প্রকৃত অর্থে দেশ উত্তরাধিকারসূত্রে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র লাভ করে। সর্বত্রই ছিল মন্দাভাব। সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়কর ছিল দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার পর বিএনপির শাসনামালে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অপরদিকে প্রতি বছর সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাস নাগাদ সারা দেশে লোডশেডিং ছিল প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালের মে মাস নাগাদ লোডশেডিং ১ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে এবং সন্ধ্যাকালীন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এ সময় বিদ্যুতের দাবিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। একই সময় রাজধানীর শনির আখড়ায় হাজার হাজার এলাকাবাসী বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলন করতে। মূলত সারা দেশের অবস্থা অভিন্ন রূপ ধারণ করে। বিদ্যুতের অভাবে কল-কারখানা বন্ধ এবং সেচ দিতে না পারায় কৃষি উৎপাদনে ধস নেমেছিল। সীমাহীন লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশোনা সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ বছর সময়। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পর দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বার্থে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতিকে এক মহাবিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রক্ষা করে।

এর ফলে ২০১১ সালের জুন মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। অবশিষ্ট ২ হাজার মেগাওয়াট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৮ হাজার ৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট।

প্রকৃতপক্ষে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পরপরই বর্তমান সরকার ভিন্নতর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের ভাষায় ‘সেটাই স্বপ্ন যা আমাদের ঘুমাতে দেয় না’ বা সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। আমাদের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের। মাত্র ১০ বছরে দারিদ্র্যের হার ২০ ভাগ এবং হতদরিদ্রের হার প্রায় ৫০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। গত বছর করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব না ঘটলে দুটির পরিসংখ্যানই শূন্যের কাছাকাছি চলে আসত। আজ বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ফল উৎপাদনে প্রথম সারিতে, মাছচাষে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, চাল উৎপাদনে নবম ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে ১১তম।

২০২০ সালে সামরিক শক্তিতে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে ৪৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার (জিএফপি) নামের একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘২০২০ : মিলিটারি স্ট্রেন্থ র‍্যাংকিং’ তালিকায় ৫০টিরও বেশি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই সামরিক শক্তিমত্তার সূচকে স্কোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ০.৭০৬৬ শক্তিসূচক নিয়ে ৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। তালিকার ক্ষেত্রে একটি দেশের সামরিক সরঞ্জামের সংখ্যার পাশাপাশি সামরিক সরঞ্জাম কতখানি বৈচিত্র্যপূর্ণ, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০ দেশ হলো- ১. যুক্তরাষ্ট্র, ২. রাশিয়া, ৩. চীন, ৪. ভারত, ৫. জাপান, ৬. দক্ষিণ কোরিয়া, ৭. ফ্রান্স, ৮. যুক্তরাজ্য, ৯. মিশর, ১০. ব্রাজিল।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনকারী দেশ হিসেবে ২০২০ সালে আবারো বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করে। এর আগেও বাংলাদেশ ২০০১, ২০০৫, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনে প্রথম হয়।

নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। ডব্লিউইএফের হিসাবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচ। প্রথম চারটি দেশ হলো- আইসল্যান্ড, নিকারাগুয়া, নরওয়ে ও রুয়ান্ডা।

নারীশিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া জাতিসংঘের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডেও ভূষিত হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। প্রায় শতভাগ মেয়েই এখন স্কুলে যাচ্ছে। প্রাথমিকে শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির কারণে স্কুলগামী মেয়েশিশুর হার বেড়েছে। ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সকল স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে।

স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে।

আমাদের স্বপ্ন এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পাবে। সবার মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার অধিকারসহ উন্নত জীবনের ব্যবস্থা করাই বর্তমান সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। এই শিক্ষা আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করেছেন। যখনই কোনো অন্যায় দেখেছেন, তার প্রতিবাদ করেছেন। এটাই বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল এবং সবসময়ই তিনি মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। এজন্য তাকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে কিন্তু নিজ আদর্শে তিনি অটল ছিলেন। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

বর্তমানে জনগণের মৌলিক চারটি চাহিদাই পূরণ করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সাফল্য এখন অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত। আজ দুর্গম গ্রামেও রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতিটি ইউনিয়নেই গড়ে তোলা হচ্ছে হাসপাতাল, যেখানে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসাও পাওয়া যাবে। এ কারণেই স্বাস্থ্য খাতে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে আমাদের সাফল্য অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত।

জনগণের আরেকটি মৌলিক চাহিদা সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাজার হাজার গৃহহীন পরিবারকে পাকা বাড়ি করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের উপার্জনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ২৩ জানুয়ারি ৬৬ হাজার ১৮৯টি গৃহহীন পরিবারের হাতে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাদের লক্ষ্য।

মুজিববর্ষে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না- জননেত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার ধারাবাহিকতায় পৌনে ৯ লাখ গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারের তালিকা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ করা নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে এই প্রকল্পের ঘর। এসব ঘরের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পরিবারগুলোর কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারা শুধু ঘর নয়, সঙ্গে পাচ্ছেন ভূমির মালিকানাও। প্রত্যেককে তাদের জমি ও ঘরের দলিল নিবন্ধন এবং নামজারিও করে দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বেদে, দলিত, হিজড়াদেরও ঘর করে হয়েছে। গত ১০ বছরে ৩ লাখ ১৯ হাজার ১৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সবার জন্য কর্মসংস্থান। ইতোমধ্যে সরকার বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে দেশে আইসিটি খাতে ১৫ লাখেরও বেশি যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

তাছাড়া বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে আরো ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ২৮টি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। আগে থেকেই বাংলাদেশে ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৫৯টি সরকারি এবং ২৯টি বেরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর্মকাণ্ড শুরু হলে চিরতরে বেকারত্বের অবসান হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

এ ছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবকাঠানো উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে নির্মাণাধীন মেট্রোরেল ও সুপার এক্সপ্রেসওয়ের কাজ সম্পন্ন হলে জন ও যান চলাচল গতিশীল হবে। এতে একদিকে জনমনে স্বস্তি, অপরদিকে অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেল-৬-এর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু হওয়ার কথা। রাজধানীতে ৬টি অংশে সর্বমোট ২০৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল ও ফ্লাইওভারে মেট্রোরেল নির্মিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী ইতিহাস রচিত হবে। এতে মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

দেশের বৃহত্তম অবকাঠামোটি নির্মিত হচ্ছে পদ্মা নদীর ওপর। পদ্মা বহমুখী প্রকল্পের অধীনে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলায় প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। এতে জিডিপি দুই ভাগ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অপরদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এশিয়ার বৃহত্তম টানেলটির নির্মাণকাজও সমাপ্তির পথে। আগামী বছর ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার চওড়া এই টানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উন্নতি ঘটাবে এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে সাগরের কোলঘেঁষে নির্মাণাধীন রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর। ২০২৬ সালে এটি চালু হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে এর ফিজিবিলিটি ও প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে। বন্দর নির্মাণে জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে।

এই মাতারবাড়ীতেই চলছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে, সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ। এটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরের চ্যানেল তৈরিতে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য করা ২৫০ মিটারের সঙ্গে আরো ১০০ মিটার চওড়া চ্যানেল, পৃথক জেটি নির্মাণ ও কনটেইনার রাখার স্থান হলে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ আরো অনেক সহজ হবে।

এর আগে জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য ছয়টি বয়া চ্যানেল তৈরি করা হয়। পরে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি বন্দরে রূপ দিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নামে প্রকল্প নেওয়া হয়।

বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে করা চ্যানেল দিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্ফ’ জেটিতে ভেড়ে। এ জাহাজ মূলত বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে ব্যবহূত সামগ্রী নিয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪ দশমিক ৪ ড্রাফটের ১২০ মিটার দীর্ঘ জাহাজটি ৭৫০ টন নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসে।

দুই ধাপে বন্দরের কাজ হচ্ছে। প্রথম ধাপে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ হবে। চাহিদার আলোকে এটা আরো বাড়তে পারে। বন্দরের সঙ্গে চার লেনের একটি সড়ক নির্মাণ হবে, যেটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে দেশ পাঁচটি বন্দরের মালিক হবে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই ইকোনমিক জোন সংলগ্ন প্রথম বেসরকারি সমুদ্রবন্দর। ২০২২ সালের শেষদিকে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হবে।

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে চলমান সকল প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ পাব। ওই বছরই আমরা উন্নত দেশের কাতারে নিজেদের স্থান করে নিতে পারব বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

একসময় আমাদের দাদি-নানি, মা-মাসীদের হূদয়নিংড়ানো আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘সন্তান যেন মোর থাকে দুধে ভাতে’। বর্তমান সময়ের খ্যাতিসম্পন্ন কবি পূর্ণেন্দু পত্রী আরেক ধাপ এগিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন- ‘সাদা রেকাবিতে সাদা ভাত, সাদা ভাতে সাদা দুধ, দুধে ঘন সর’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী শুরুর এই স্বর্ণ-সন্ধিক্ষণে আমরা বলতে পারব না আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য ‘দুধ-ভাত’ নিশ্চিত করা যাবে কি-না। তবে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিয়ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ স্বাধীন জাতির অহংকার ও আত্মবিশ্বাসের অগ্রভেদী দাপট নিয়ে একথা আমরা জোর গলায় বলতে পারব- এই বাংলায় আর কোনোদিন কেউ না খেয়ে মরবে না। মাথার উপর বিনাছাউনিতে কেউ রাত কাটাবে না। অনাগত কালে কোনো গবেষক বাংলাদেশে দারিদ্র্য-ক্ষুধা-বঞ্চনা খোঁজ করতে এলে তাকে জাদুঘরে যেতে হবে।

 

লেখক : বাংলাদেশের খবর ও বাংলাদেশ নিউজের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এবং দিন পরিবর্তনের সম্পাদক ও প্রকাশক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads