• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

শিক্ষা

এমসিকিউ তুলে দেওয়া প্রসঙ্গে

  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০১৮

একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসিসহ পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সম্ভাব্য ছয়টি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু কোথা থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে কিংবা কারা করছে তা নিয়ে কেবল পর্যালোচনাই হয়েছে। ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি— তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২ এপ্রিল শুরু হতে যাওয়া এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার উদ্বেগ তারপরেও যাচ্ছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিলেও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পারেনি। বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ালে আদালত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করে বিচারিক ও প্রশাসনিক দুটি পৃথক কমিটি গঠন করেছেন। এখন এই কমিটি তাদের কর্মসম্পাদনে পরিকল্পনা করে চলেছেন। তবে বিভিন্ন মহলের আলোচনা ও পত্রপত্রিকার খবরে যেটি এসেছে তা হচ্ছে সরকার চাচ্ছে এমসিকিউ প্রশ্ন বাদ দিয়ে সব প্রশ্নই সৃজনশীল/রচনামূলক হবে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সভায় পিইসি পরীক্ষা থেকেও এমসিকিউ তুলে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এরও আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) চলতি বছরের পিইসি পরীক্ষার যে চূড়ান্ত নম্বর বিভাজন প্রকাশ করে, তাতে এমসিকিউ রাখা হয়। ছয়টি বিষয়ের মধ্যে বাংলায় ১০, ইংরেজিতে ২০, গণিতে ২৪, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ে ৫০, প্রাথমিক বিজ্ঞানে ৫০ ও ধর্ম বিষয়ে ৫০ নম্বরের এমসিকিউ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

উন্নত বিশ্বের মূল্যায়ন পদ্ধতির অনুকরণে নব্বইয়ের দশকে ৫০ নম্বরের বহুনির্বাচনী অভীক্ষা শুরু করা হলো আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে। নির্দিষ্ট ৫০০ এমসিকিউয়ের মধ্যে থেকেই ওই ৫০টি প্রশ্ন সেট করা হতো। এ জন্য যে পরিমাণ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ দরকার ছিল তার ধারেকাছেও যাওয়া হয়নি। বলা যায়, হঠাৎ করেই চালু করা হলো। ফল হলো পাসের ছড়াছড়ি। শিক্ষার্থীরা মূল বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করল। বাজারে চলে এলো এমসিকিউ গাইড। একজন শিক্ষার্থী কোনোরকম টিক দিয়ে ৩৩ পেলেই পাস আর যারা আরো একটু চালাক তারা অতি সহজেই এক-একটি বিষয়ে ৬০, ৭০ এবং ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া শুরু করল মূল বই না পড়েই। ফলে হাজার হাজার লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্টার মার্কস পাওয়া শুরু করল। ফলে ১৯৯৬ সালে বহু বিষয়ের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে এমসিকিউয়ের নম্বর কমিয়ে ফেলা হলো। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৭০ শতাংশ প্রশ্ন ছিল সৃজনশীল আর ৩০ শতাংশ  এমসিকিউ।

এই অবস্থায় আগামী বছর থেকে এমসিকিউ বাদ দেওয়া মানে হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা যারা ওই বিষয় নিয়ে ওই ধারণা নিয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে এসেছে, পরীক্ষা দিয়ে এসেছে তাদের বিড়ম্বনায় ফেলা। মূলত এসএসসির পড়াশুনা শুরু হয় নবম শ্রেণি থেকেই। আগামী বছর যারা এসএসসি পরীক্ষা দেবে তারা কিন্তু নবম শ্রেণিতে এমসিকিউতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ করে এমসিকিউ না থাকলে তাদেরকে ঠকানো হবে, দ্বিতীয়ত ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। এটি ঠিক যে, এমসিকিউ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে খুব দ্রুত একে অপরকে বলে দেয়- ফলে প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। আবার এগুলোও তো ঠিক যে, এমসিকিউ করা হয়েছিল শিক্ষার্থীরা যাতে মূল বইটি ভালো করে বার বার পড়ে। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো সিলেবাসের সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে শিখতে হয়। এই পদ্ধতিতে নতুন, পুরনো, অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ সকল ধরনের পরীক্ষকই এমসিকিউয়ের সঠিক উত্তরের জন্য নম্বর প্রদান করতে বাধ্য থাকেন। রচনামূলক বা সৃজনশীল পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ শিক্ষক একরকম, অনভিজ্ঞ  এবং নতুন পরীক্ষক অন্যরকম নম্বর প্রদান করেন। এমসিকিউ থাকলে শিক্ষার্থীরা একেবারে অবিচারের শিকার হয় না, কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার পায়। কিন্তু আমরা এমসিকিউ প্রশ্ন যেভাবে সেট করি সেখানে সমস্যা রয়েছে। এমসিকিউ তো একবারে ধারাবাহিক দিলে হবে না। দিতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও চতুরতার সঙ্গে। যেমন বড় প্রশ্নের মধ্যে প্রসঙ্গের সঙ্গে মিল রেখে কয়েকটি এমসিকিউ। তা আবার ‘ক’ সেটে একরকম, ‘খ’ সেটে অন্যরকম। বিষয় ও উত্তর একই থাকবে। প্রথম থেকে ত্রিশটি এমসিকিউ থাকা ঠিক নয়। প্রশ্নের মাঝে মাঝে থাকবে। এক সেটে যে প্রশ্ন থাকবে দুই নম্বরে অন্য সেটে সেটি আরো ওলটপালট করে থাকবে ছয় নম্বর প্রশ্নে। এভাবে থাকলে শিক্ষার্থীরা সহজে বলাবলি করতে পারবে না।

আবার ২০১০ সাল থেকে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষাগ্রহণ শুরু করা হয় কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। সাত-আট বছর পরেও সৃজনশীল প্রশ্ন আয়ত্ত করতে পারছে না অধিকাংশ শিক্ষক। ফলে, প্রসার ঘটেছে নোট-গাইডের আর শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তার জায়গাটি হয়েছে আরো সঙ্কুচিত, সেই সঙ্গে শিক্ষকদেরও। শিক্ষাবিদ, সচেতন অভিভাবক, নাগরিক সমাজ ২০১০ সালের পর থেকে বার বার শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলে আসছেন যে, পরীক্ষা শিক্ষার অর্জিত ফল যাচাইয়ের কৌশল বটে, কিন্তু কিছুতেই পরীক্ষা শিক্ষণ-শিখনের বিকল্প নয়। কিন্তু আমরা পরীক্ষাকেই মুখ্য বিষয় ভেবে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলেছি আর সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে পরীক্ষানির্ভর করে ফেলেছি। তার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, সার্টিফিকেটধারীদের ৯০ ভাগেরই অর্জিত জ্ঞান কাঙ্ক্ষিত মানের অনেক নিচে। তা ছাড়া শিক্ষাসংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠান যেমন মাউশি, এনসিটিবি, নায়েম, এনটিআরসিএ, বিভিন্ন টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোতে রাজনৈতিক পরিচয়ে অযোগ্য শিক্ষক ও কর্মকর্তায় ভরে ফেলা হয়েছে। 

অন্যদিকে এবার এসএসসির প্রশ্নপত্র বিজি প্রেসে ছাপা হওয়ার পর তার মূল প্লেট ধ্বংস করা হয়নি। মূল প্লেট রেখে দেওয়া হয়েছিল অরক্ষিত অবস্থায়। সেখান থেকে যে-কারো পক্ষে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা সম্ভব। প্রশ্নপত্র ছাপানোর পর হাতে হাতে প্যাকেজিং করেন বিজি প্রেসের কর্মচারীরা। কারো হাতের ছাপ ছাড়া অটোমেশন পদ্ধতিতে প্যাকেজিং করার ব্যবস্থা না থাকায় সেই প্রক্রিয়া থেকেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বিজি প্রেসে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে সিটিটিভি বসিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপানোর সঙ্গে জড়িতদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়, সেখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সিসিটিভিতে মুভিং সিস্টেম বাসানো। এতে একপাশ ঘুরে আসার সময় সিসিটিভির আওতার বাইরে থাকছে অন্যপাশ। বর্তমানে বিজি প্রেসে যেভাবে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়, তাতে একটি প্রশ্নপত্রের পাণ্ডুলিপি গ্রহণ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং হওয়া পর্যন্ত ২০০-২৫০ জন সম্পৃক্ত থাকেন যারা সংস্থাটির প্রশ্নপত্র নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করেন। সবাই তখন প্রশ্নপত্র দেখতে পারেন। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা হতে লেগেছিল প্রায় দুই মাসের বেশি। প্রতিটি প্রশ্নের দুটি করে সেট ছাপা হয়েছিল। ছাপা হওয়ার পর প্রশ্নের প্রুফ দেখেন ১৫-২০ জনের একটি দল। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এসব কারণগুলো না খুঁজে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, এমসিকিউ বাদ দিতে হবে, তা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

শিক্ষার পরিকল্পনা হতে হয় সুদূরপ্রসারী— কারণ একটি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার তৈরি হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। শ্রেণিভিত্তিক সিলেবাসে ভাগ করা হয় শিক্ষার পুরো কারিকুলামকে যা তৈরি করা অনেক দুরূহ, কঠিন, অত্যন্ত দক্ষতাসম্পন্ন ও পেশাগত কাজ। এই কাজে প্রয়োজন নিরন্তর গবেষণা। এখানে প্রকৃত শিক্ষিত, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের প্রয়োজন। এগুলোর দিকে না তাকিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের ওপর যা-তা যখন-তখন চাপিয়ে দিতে পারি না। তাহলে তারা ভবিষ্যতে আমাদের ক্ষমা করবে না।

 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ (শিক্ষক)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads