• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

শিক্ষা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাতভর সংঘাত

  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০১৮

শাহবাগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলার পর উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শাহবাগ মোড় সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখার পর রোববার রাত ৮টার দিকে লাঠিপেটা ও রাবার বুলেট-কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে তাদের হটিয়ে দেয় ‍পুলিশ। এরপর অবরোধকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে সরে আসলে তাদের উপর চড়াও হয় ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী।

মধ্যরাতের পর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ব্যপারে অবগত আছেন। প্রধানমন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আন্দোলনকারীদের সাথে সোমবার সকাল ১১টায় বসার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি। কিন্তু তার কথায় আন্দোলনকারীরা শান্ত হয়নি।

এই সংঘাত রাত পৌনে ২টা পর্যন্ত চলছিল। বিক্ষোভ থেকে অনেককে আটক করতে দেখা যায় পুলিশকে। তবে কত জন আটক হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। রাত দেড়টার পর আন্দোলনরত একদল শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাড়ির ফটক ভেঙে ঢুকে বিভিন্ন আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের নেতারা হলগুলোতে ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না। টিএসসি এলাকায় ছাত্রদের বিক্ষোভের মধ্যেই রাতে সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা হাইকোর্ট-বঙ্গবাজার সড়কে নেমে আসে; মিছিল নিয়ে নামে কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরাও।

পুলিশের রাবার ‍বুলেটে বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বঙ্গবন্ধু হলের আবু বকর সিদ্দিককে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার চোখের কোনে জখম হয়েছে। এছাড়া রাবার বুলেটের আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে।

পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হন অর্ধ শতাধিক আন্দোলনকারী। আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটে তিনজন পুলিশ সদস্যকেও আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিতে দেখা যায়। দুপুরে অফিস ছুটির ওই সময় শাহবাগে অবরোধের কারণে গাড়ি না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।

ওই সময় মৎস্য ভবন, টিএসসি ও সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে শাহবাগমুখী যানবাহন ঘুরিয়ে দিচ্ছিল পুলিশ। ফলে ওই সব মোড় ঘিরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’।

১৪ মার্চ তারা ৫ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দিতে সচিবালয় অভিমুখে যেতে চাইলে পুলিশি ধরপাকড় ও আটকের শিকার হন। তারপর নানা কর্মসূচি পালনের পর রোববার পদযাত্রার কর্মসূচি দিয়ে শাহবাগে অবস্থান নেয় তারা। বেলা আড়াইটার দিকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে তারা সমবেত হয়। ঘণ্টাখানেক পর তারা মিছিল করে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে যুগ্ম আহ্বায়ক মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটায় শূন্য থাকা সিটে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে, সেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, এক কোটার শূন্য আসন অন্য কোটা দিয়ে পূরণ করা হবে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান কোটা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি, মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে। এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা সেখানেই।’

পরিষদের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান আল মামুন বলেন, ‘সংসদে অধিবেশন চলছে, সংসদে যারা আছে তারা আমাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। আজকে আমরা দেখব, তারা জনগণের জন্য কী করে। সংসদে আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিলে তবেই আমরা রাস্তা ছাড়ব। আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস, কেউ যদি আমাদের বুকে গুলিও চালায় আমরা কিছু করব না।’

পুলিশ জলকামান নিয়ে বিক্ষোভের শুরু থেকে অবস্থান নিলেও ছিল সংযত। তারা অবরোধকারীদের সড়ক ছাড়ার অনুরোধ করলেও তাতে সাড়া মিলছিল না। বিকাল ৫টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী উপকমিশনার (এডিসি) আজিমুল হক ‘জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি না করে সরে যেতে বললেও বিক্ষোভকারীরা অনড় থাকে।

এসময় বেশ কয়েকজন হাতে গোলাপ নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলে এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটে। এরপর ডিএমপির রমনা জোনের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের জানান, ‘তারা আন্দোলন করছে, করুক। জনদুর্ভোগ যাতে না হয়, সেজন্য অনুরোধ করছি।’

রাত ৮টার দিকে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া শুরু করে; অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শুরু করে লাঠিপেটা। পুলিশের হামলার মুখে কয়েক মিনিটের মধ্যে শাহবাগ মোড় থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। সড়ক হয়ে যায় ফাঁকা। পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হওয়ার সময় কর্তব্যরত কয়েকজন সাংবাদিককেও লাঠিপেটা করে।

ওই সময় পাবলিক লাইব্রেরির সামনে পাঁচ সংবাদকর্মী ঢাকা ট্রিবিউনের ফাহিম রেজা নূর, প্রথম আলোর আসিফুর রহমান, ইউএনবির ইমরান হোসেন, বাসসের কামরুজ্জামান রেজা এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তারেক হাসান নির্ঝরের উপর পুলিশ হামলা চালায়।

পুলিশের ধাওয়ায় আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঢুকে পড়ে চারুকলার সামনে অবস্থান নিয়ে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তখন পাবলিক লাইব্রেরির সামনে অবস্থান নিয়ে থেমে থেমে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ছিল পুলিশ। এক পর্যায়ে পুলিশ এগিয়ে এসে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে।

পুলিশের আক্রমণে পিছু হটে আন্দোলনকারীরা টিএসসির দিকে সরে এলে তাদের উপর চড়াও হয় ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। ভিডিও ধারণের সময় এক সাংবাদিকের মোবাইল ফোনটিও ভেঙে দেয় ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।

ছাত্রলীগে নেতাদের মধ্যে এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু।

প্রিন্স সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, আন্দোলনকারী টিএসসি ভাংচুর শুরু করতে গেলে তারা বাধা দিয়েছেন। রাত পৌনে ৯টার দিকে বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে এলেও পৌনে ১০টার দিকে আবার শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে টিএসসিতে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা টিএসসির দিক থেকে ইট ছুড়তে থাকলে পুলিশও রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তার জবাব দিতে থাকে।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিএসএসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে সমাবেশ করে বিক্ষোভকারীরা। সেখানে পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন সোমবার থেকে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেন। এর মধ্যে হাইকোর্ট-বঙ্গবাজার সড়কে নেমে সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানায়।

আন্দোলনকারীদের সমন্বয়কারী পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফেরদৌস জাহান অন্তি বলেন, শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাব চান তারা।

বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আবাসিক শিক্ষকরা হলের ফটক বন্ধ করে দিয়েছেন, কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছে না, বের হতেও দিচ্ছে না।শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এক ছাত্রীকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সুফিয়া কামাল হলের মতো কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরাও রাতে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসে।

রাত দেড়টার দিকে দুই ছাত্রী হলের পাঁচশর বেশি ছাত্রী কলাভবনের সামনে এসে ছাত্রদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads