• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে রাতের আঁধারে ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিক্ষোভ ।

ছবি: বাংলাদেশের খবর

শিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটছে?

· স্তম্ভিত সুশীল সমাজ, নিন্দা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০১৮

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে সুফিয়া কামাল হল থেকে ৩ ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আরেক ছাত্রীর অভিভাবক এলেও রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে হলে থাকতে দেওয়া হয়। তবে শুধু ওই তিনজনই, নাকি আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে সে বিষয়ে নানা ধরনের বক্তব্য আসায় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়েছে। 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যারা সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাদের ‘তদন্তের নামে হয়রানি’ করছে হল কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ফোন পরীক্ষা করে ফেসবুকে কে কোন পোস্ট দিয়েছে তা যাচাই করা হয় বলে হলের ছাত্রীরা জানিয়েছে। এর মধ্যেই তিন ছাত্রীকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে কোটা আন্দোলনের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গতকাল শুক্রবার বিকাল ৪টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে নিতে বলেছে। এই বিতাড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হলের শয্যা হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত। তিনি স্যার এফ রহমান হলের ৪০৭ নম্বর কক্ষে থাকতেন। এখন বুয়েটের একটি হলে পরিচিত এক ‘বড় ভাইয়ের’ কাছে আছেন ইয়াসিন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ওই তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়নি। অভিভাবকরা তাদের বোঝানোর জন্য নিয়ে গেছেন। তবে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, মধ্যরাতে তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় আমি স্তম্ভিত। একই সঙ্গে তিনি মূল ঘটনা পরিষ্কার করে নিয়ম অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ রকম আচরণ করতে পারে, এটা ভাবা যায় না। কেউ যদি ভুল করে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে কোথাও লেখা নেই যে, রাত ১২টার সময় কোনো ছাত্রীকে স্থানীয় অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া যায়। এটা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এ ঘটনায় চটে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানান। কেউ কেউ লিখেছেন, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ মধ্যরাতে মেয়েদের হলে পুলিশ ঢুকিয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলেন। আর বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান মধ্যরাতে মেয়েদের হল থেকে বের করে দিয়েও নির্বিকার।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গতকাল বলেন, ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগের পর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে গুজব, উসকানি ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। কোনো গুজবে কান দেবেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না। আন্দোলনকারী আর উসকানিদাতা এক নয়। আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। যৌক্তিক দাবিতে যে কেউ আন্দোলন করতে পারে। তবে উসকানি আলাদা বিষয়। আমরা আন্দোলনকে সমর্থন করি, উসকানিকে নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলেও এতে অপশক্তি ঢুকে গিয়েছিল বলে মনে করেন উপাচার্য। তিনি জানান, কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়রানি করেনি। হাজার হাজার ছাত্র এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যে মাত্র ২৫-২৬ জনকে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। তিনি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত না হয়ে কোনো সংবাদ পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, মেয়েদের হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা সত্য নয়। অভিভাবকরা এসে তাদের নিয়ে গেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। কেন মেয়েদের হল ছাড়তে হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা হল কর্তৃপক্ষ জানে।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ছাত্রলীগের অবস্থান : হল থেকে ছাত্রী বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। একই সময় রাজু ভাস্কর্যের উত্তর দিকের ফুটপাথে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয়। বিক্ষোভকারীরা আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে নিতে হবে। নতুবা বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘হলে হলে নির্যাতন বন্ধ কর’ ‘করতে হবে’, ‘আমার বোন বাইরে কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘হলে হলে নির্যাতন কেন প্রশাসনের জবাব চাই’, ‘নির্যাতন করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান ও নুরুল হক নূর। বের করে দেওয়া ছাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন অন্তি (পদার্থ), রিমি (পদার্থ) ও শারমিন (গণিত)। তবে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে দাবি করেছেন বেশ কয়েকজন ছাত্রী। তারা বলেন, প্রাধ্যক্ষ অন্য মেয়েদের হল থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। ফেসবুকে যাতে কোনো ধরনের পোস্ট দেওয়া না হয় সে ব্যাপারেও হুশিয়ার করেছেন তিনি।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, এটি হল প্রশাসনের ধৃষ্টতা। আমরা প্রশাসনকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। এর মধ্যে কোনো আলোচনা ছাড়াই কেন তারা এমন সিদ্ধান্ত নিল, আমরা তার জবাব চাই।

দুই হাজার ছাত্রীকে বহিষ্কারের হুমকি প্রাধ্যক্ষের : ‘আমার কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, কারা কারা করেছে। দুই হাজার মেয়ে যদি করে থাকো, লিখিত স্বাক্ষর দাও। নতুবা বহিষ্কার করা হবে’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রিজওয়ানা রহমান এ হুমকি দিয়েছেন। তবে এ বক্তব্য অস্বীকার করেছেন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এই অধ্যাপক। সাবিতা রিজওয়ানা বলেন, ছাত্রীরা বলছিল, ওই দিন (১০ এপ্রিল রাতে) আমরা সবাই ছিলাম, সবাই মারামারি করেছি। তখন আমি বলেছি, হলে কিন্তু সিসি ক্যামেরা রয়েছে, সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। আমি দুই হাজারের কথা বলিনি, তারাই বলেছে। মাঝরাতে ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হল থেকে কাউকে বের করে দেওয়া হয়নি। চারজন ছাত্রীর অভিভাবককে ডাকা হয়েছিল কাউন্সেলিংয়ের জন্য, তাদের মধ্যে তিনজনের অভিভাবক লিখিত দিয়ে তাদের মেয়েদের নিয়ে গেছেন। কারো সিট বাতিল হয়নি। বহিষ্কার করাও হয়নি। চাকরির কারণে দুই অভিভাবক দেরি করেছিলেন। এর মধ্যে একজন রাত ১২টার দিকে এলে আমরা ওই ছাত্রীকে নিয়ে যেতে দিইনি। যেহেতু তিনি ধামরাইয়ে থাকেন।

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর প্রাধ্যক্ষের কক্ষে ছাত্রীদের বহিষ্কারের হুমকি দেন সাবিতা রিজওয়ানা রহমান। এর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাফেরা করছে। হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ১০ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের হল সভাপতি ইফফাত জাহান এশাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ছাত্রীদের ডাকেন হল প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রিজওয়ানা। কথার একপর্যায়ে তিনি ছাত্রীদের বহিষ্কারের হুমকি দেন। ওই রাতে কয়েকজন ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads