• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
টাকা হাতানোর অভিনব পন্থা

টাকা হাতানোর এক অভিনব ‘পন্থা’ আবিষ্কার করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

সংরক্ষিত ছবি

শিক্ষা

টাকা হাতানোর অভিনব পন্থা

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৮

regular_2341_news_1527351681

টাকা হাতানোর এক অভিনব ‘পন্থা’ আবিষ্কার করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনা নয়, নানা ফন্দি-ফিকিরে অর্থ আদায়ই সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থী। অনেকে মজা করে একে ডাকছেন ‘ব্যবসা সেন্টার’ নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ‘কাবুলিওয়ালা’ চরিত্রের প্রতিবাদে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে মানববন্ধন হয়েছে আর শ্রীমঙ্গলে হয়েছে সংবাদ সম্মেলন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৬-১৭ সালে স্নাতক (পাস) কোর্সে যারা ভর্তি হন, তাদের অনেকে পরের বছর স্নাতক (সম্মান) কোর্সে চলে যান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা আগের ভর্তি বাতিল করেননি। তবে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভর্তি বাতিলের জন্য কলেজগুলোয় যথাযথভাবে আবেদন করেছিলেন তারা। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য, তাদের ভর্তি বাতিল হয়নি। সারা দেশে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত, ঠিক তাও জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন শিক্ষার্থীদের ওপর আকস্মিকভাবে জরিমানা ধার্য করেছে। গত ১৭ মে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ওই শিক্ষার্থীদের আগের ভর্তি বাতিল হয়নি। যারা প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাদের ৭ হাজার ৫০০ এবং যারা পরীক্ষায় অংশ নেননি তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। একইভাবে ২০১৫-১৬ ও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু এখন আবার যারা অংশ নিতে চান, তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডও ইস্যু করা হয়নি। তাদেরও একই পরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও আচরণ করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে এমন লাগামহীন টাকা আদায়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। এ ছাড়া সেশনজট কমাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে ‘ক্রাশ’ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিল, সেটিরও সমালোচনা করেছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই ক্রাশ প্রোগ্রাম এখন ‘ত্রাস’ প্রোগ্রামে পরিণত হয়েছে। এক বছরে শিক্ষাকার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক শিক্ষাকার্যক্রম সাত মাসে শেষ করে পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করার আদেশ দেয়। যার মধ্য দিয়ে পড়াশোনার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিই ফুটে ওঠে।

এ বিষয়ে তিন দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির জনসংযোগ, তথ্য ও পরামর্শ দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. ফয়জুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দোষ খুঁজে পাননি বলে জানান। তার মতে, এখানে শিক্ষার্থীরাই দোষী। কারণ তারা কেন দুবার ভর্তি হবেন। এর জন্য শিক্ষার্থীদেরই জরিমানা গুনতে হবে বলে জানান তিনি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে যতই নিজেকে নির্দোষ ভাবুক না কেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ করে লিখেছেন, হঠাৎ করে সারা দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে হয়রানি করে বিক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করবেন না। শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল ফি ৭০০ টাকা, অথচ বিলম্বে পরিশোধে জরিমানা ১০ হাজার টাকা?

তিনি আরো লেখেন, অনার্স ২০১৬-১৭ সেশনে ভর্তি বাতিল করার পরও অনেকের রেজিস্ট্রেশন কার্ড আসেনি। আবার অসংখ্য শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিলের আবেদন করে সব নিয়ম মেনে অন্য কলেজে ভর্তি হলেও কলেজগুলো তাদের ভর্তি বাতিলের আবেদন আমলে নেয়নি, ফলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর হয়রানিটা তিনি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন বলে জানান।

ফরম পূরণ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন কার্ড ছাড়া তা কীভাবে সম্ভব? কলেজ থেকে বলা হচ্ছে, জরিমানার ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। খবর নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে আনুমানিক ৭০০ শিক্ষার্থী এমন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ঘটনা জানাজানির পর গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনে তারা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই জরিমানার বিজ্ঞপ্তি বাতিল না করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

চট্টগ্রামের হাজী মোহাম্মদ মুহসীন কলেজের শিক্ষার্থী মাইনুর মোহাম্মদ বলেছেন, ভর্তি বাতিলের জন্য এক হাজার টাকা দেওয়ার পর পাঁচ-ছয় মাস আগে কলেজ থেকে অফিস সহকারী আমাকে বলেছিলেন ভর্তি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু দুদিন আগে জানতে পারলাম, তারা কোনো কাজই করেনি। এখন এত টাকা কী করে দেব, আর এতে কী দোষ ছিল আমার?

এদিকে গত বুধবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত জরিমানা মওকুফের দাবিতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী বিথিকা রাণী সিনহা। এ সময় তার সঙ্গে ফারিয়া সুলতানা, নিয়াজ আহমদ, প্রিয়াঙ্কা দেবনাথ, বিশাল দেবসহ আরো কয়েকজন ছিলেন।

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী (আগে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে স্নাতক (পাস) কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে অনার্স নিয়েছেন) প্রিয়াঙ্কা দেবনাথ বলেন, ‘স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে জানতে পারি আমাদের ২০১৬-১৭ সেশনের স্নাতক (পাস) বাতিল না করায় অতিরিক্ত মাত্রায় জরিমানা ধার্য করা হয়েছে, যা অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে এ জরিমানা মওকুফের দাবি জানাচ্ছি।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী বিথিকা রাণী সিনহা বলেন, আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এই অতিরিক্ত জরিমানা আমাদের ওপর জুলুমের শামিল।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, সারা দেশের বিভিন্ন কলেজের বহু শিক্ষকও ফেসবুকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কলেজ শিক্ষক বলেন, বহু শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিলের আবেদন করে বিভিন্ন কলেজে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এ দায় কার? অনেক কলেজে অনলাইন জটিলতার কারণে অথবা গাফিলতির কারণে ভর্তি বাতিল হয়নি। তাদের প্রশ্ন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করার সময় কেন তাদের অনুমতি দিল? তাদের এইচএসসির রোল নম্বর তো আগের বছর ভর্তির তালিকায় ছিল। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ওপর টাকার দায় চাপাচ্ছে কেন? শিক্ষকরা বলছেন, জরিমানা যদি দিতেই হয় তা হতে পারত ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। ১০ হাজার টাকা জরিমানা না দিলে দ্বৈত ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেওয়া হবে না- এমন হুমকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও দেয় না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads