• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
মাফ চেয়ে পার পেল ভিকারুননিসা স্কুল

ভিকারুননিসা স্কুল

সংরক্ষিত ছবি

শিক্ষা

মাফ চেয়ে পার পেল ভিকারুননিসা স্কুল

শুধু ‘সতর্ক করল মন্ত্রণালয়

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০১৮

চলতি বছর টাকার বিনিময়ে ও তদবিরের মাধ্যমে কয়েক শ শিক্ষার্থী ভর্তি করার পর ‘মাফ চেয়ে’ পার পেল রাজধানীর অন্যতম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হয়নি। এতে নানাজন প্রশ্ন তুলে বলেছেন, রাজধানীর আরেকটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি কেলেঙ্কারির জন্য যেখানে তিন দফা তদন্ত হচ্ছে, ঘষামাজা করা ৬৯টি উত্তরপত্র জব্দ হয়েছে, সেখানে একই অপরাধ করেও ভিকারুননিসা রেহাই পেল কেন? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন শুধু ‘সতর্ক’ করে ছেড়ে দিল।

তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোন শ্রেণিতে কয়টি আসন আছে তার বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি পাঠায়। একই সঙ্গে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে চলতি বছর চার শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল। এর মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদবির রয়েছে। এই সুযোগে পরিচালনা পর্ষদ টাকার বিনিময়ে ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করে।

এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৭ মে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চায়। কিন্তু চিঠির জবাব না দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলে, আমরা নীতিমালা না মেনে কাদের ভর্তি করিয়েছি সেটা দেখেন। তাতে দেখা যায়, একাধিক মন্ত্রী, অন্তত তিনজন এমপি ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ভর্তি করানো হয়েছে। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর তদন্ত করার ‘সাহস’ দেখায়নি। বদলে মন্ত্রণালয় থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়, আপনারা একটা লিখিত দিন ভিকারুননিসায় ভর্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আর এমন অনিয়ম হবে না। এতে রাজি হয়ে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২০ আগস্ট চিঠি দিয়ে ভিকারুননিসা অধ্যক্ষকে জানায়, স্কুলের নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে নীতিমালা না মেনে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি না করার জন্য সতর্ক করা হলো। এর ব্যত্যয় হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালেও অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির কারণে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। এর আগের বছরও অভিযুক্ত হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ভর্তি নীতিমালা না মানায় ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই বছর স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৬৮ লাখ ১৭ হাজার ১০০ টাকা আদায় করেছিল। চলতি বছর ভর্তির জন্য জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহম্মেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ভর্তির ক্ষেত্রে ওরা (ভিকারুননিসা) যে পরিমাণ অন্যায় করেছে, তাতে তাদের আরো কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু শুধু ‘সতর্ক’ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবীর দুলু বাংলাদেশের খবরকে জানান, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মুখে ভালো ভালো কথা বলেন। কিন্তু কাজের বেলায় ‘ঠনঠন’। তিনি বলেন, তদবিরে বা সুপারিশে ভর্তির কোনো নিয়ম নেই, তবু সুপারিশে ভর্তি করা হয়েছে। অথচ তদন্তই হলো না। কার কাছে বিচার চাইব। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি সত্যি সত্যি ভর্তি-বাণিজ্য বন্ধ করতে চায় তাহলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে চাকরিচ্যুত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিকারুননিসা নূন স্কুল পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য বলেন, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিসহ সব সদস্য এবং কিছু শিক্ষকের ব্যাংক হিসাব ও অবৈধ সম্পত্তির খোঁজ নিতে দুদকের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ একাধিক সদস্য এমন অপকর্মে মূল ভূমিকা রাখছেন। প্রতি শ্রেণিতে নির্ধারিত আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে স্কুলটিকে পুরোপুরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। কিন্তু এ অভিযোগ মানতে নারাজ স্কুলের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ভর্তি কেলেঙ্কারি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুটোই ‘নেতিবাচক শব্দ’- মূলত বিষয়গুলো এমন নয়। তার মতে, মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন কর্মকর্তার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নীতিমালার বাইরে গিয়েও কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সেসব বলেছি। মন্ত্রণালয়কে এও বলেছি, ভবিষ্যতে এভাবে ভর্তি করানো হবে না। মন্ত্রণালয় আমাদের শুধু ‘সতর্ক’ করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করেছে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ভর্তির অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, এভাবে বলাটা উচিত নয়। তারা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাদেরও কিছু সুপারিশ ছিল। প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে তাদের সুপারিশও মানতে আমরা বাধ্য। তবে ভর্তির ক্ষেত্রে টাকার লেনদেন হয়েছে কি না, তার জবাব তিনি দেননি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রীর সুপারিশে কিছু ভর্তি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আশরাফ তালুকদার স্বীকার করেছেন, চলতি বছর ২০৯ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাদের সুপারিশও ছিল। তবে আমরা রাষ্ট্রের আইন মানার পক্ষে। কিন্তু এবার আপনারা আইন মানলেন না কেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ভিকারুননিসায় নতুন সভাপতি হয়েছি। আমার আগে থেকেই এখানে ‘অবৈধ প্র্যাকটিস’ ছিল। হয়তো সে কারণে এবারো ভর্তি হয়েছে। এ জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভবিষ্যতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বা নির্দেশ ছাড়া কারো কথা কিংবা টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে না। আপনিও টাকা নিয়ে ভর্তি করিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে- এ অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, কিছু লোক রয়েছে যারা অন্যের ভালো দেখতে পারে না। হয়তো ওরাই আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads