• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ভিকারুননিসায় শুদ্ধি অভিযান

অরিত্রী আত্মহত্যার ঘটনায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গতকাল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

শিক্ষা

ভিকারুননিসায় শুদ্ধি অভিযান

# অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষক বরখাস্ত, বাতিল হলো এমপিও # ব্যবস্থা নিতে র্যাব-পুলিশকে চিঠি # রোববার থেকে শুরু ক্লাস-পরীক্ষা # আজো বিক্ষোভ করবে শিক্ষার্থীরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহননের প্ররোচনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসসহ তিন শিক্ষককে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বরখাস্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। অন্য দুই শিক্ষক হলেন, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণি শিক্ষক হাসনাহেনা। এর আগে গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বরখাস্তের আদেশ দেন। দুপুরে বরখাস্তের আদেশ শুনেই অভিযুক্তরা আত্মগোপনে চলে যান। অধ্যক্ষ কোথায় জানতে চাইলে পরিচালনা পর্ষদের শিক্ষক প্রতিনিধি মুশতারি সুলতানা বলেন, ‘তিনি অসুস্থ।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই সঙ্গে ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে র্যাব ও পুলিশকে চিঠি দিয়েছে। পাশাপাশি আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের এমপিও বাতিল করতে মাউশি মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজধানীর অন্যতম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। গতকাল বুধবার অরিত্রীর আত্মহত্যার জন্য দায়ী অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া চিঠিতে এই অভিযোগ তুলেছে বোর্ড। শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয় গভর্নিং বডি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা তদারকি, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের বিরূপ আচরণ, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি সংক্রান্ত অনিয়ম, স্যানিটেশন সমস্যার বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের।

শুদ্ধি অভিযান সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা এখনো ক্ষুব্ধ। গতকাল দিনভর তারা বিক্ষোভ করেছে এবং ছয়দফা দাবি জানিয়েছে। গতকাল সকালে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করার কথা জানানো হলেও বিকালে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ বলেছে, রোববার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা ফের শুরু হবে। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে স্কুলটির নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনুষ্কা রায় দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন স্থগিত করে জানায়, স্কুলের গভর্নিং বডির অপসারণসহ ৬ দফা দাবি আদায়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফের বিক্ষোভ করবে শিক্ষার্থীরা।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় পর্ষদ বৈঠকে অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষকের বরখাস্তের আদেশ বাস্তবায়ন করা হয়। আগামী দুই বা তিন দিনের মধ্যে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বুধবারের (৫ ডিসেম্বর) স্থগিত বার্ষিক পরীক্ষা শুক্রবার (৭ ডিসেম্বর) এবং বৃহস্পতিবারের (৬ ডিসেম্বর) পরীক্ষা ১১ ডিসেম্বর নেওয়া হবে। আগামী রোববার থেকে স্কুল-কলেজের ক্লাস স্বাভাবিক হবে। শিক্ষার্থীরা গভর্নিং বডির পদত্যাগ দাবি করছে- এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আশরাফ তালুকদার বলেন, আলোচনা করেছি। গভর্নিং বডির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অরিত্রীর মৃত্যুর দায় কার- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক কেউ দায়মুক্ত নয়।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেছেন, অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের দায় রয়েছে। তবে এখনই পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়নি। এ নিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।  

‘কর্তৃপক্ষের নির্দয়-নির্মম আচরণেই অরিত্রীর আত্মহত্যা’

অরিত্রীর আত্মহননের পর গঠিত তদন্ত কমিটি স্কুলটির নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তিন দিন আগে ওই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি রাতদিন কাজ করে প্রতিবেদন দেয় গতকাল বুধবার। বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্মম, নির্দয় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, আমরা মর্মাহত, ব্যথিত। খুবই অমানবিক। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া হয়েছে। নাহিদ বলেন, প্রতিবেদনে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এখানে বলা হয়েছে, এই তিনজন, অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসলেন, তারা খুবই অসুস্থ, তাদের ভয়-ভীতি দেখান, অরিত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে অধ্যক্ষ, শিফট ইনচার্জ নির্মম, নির্দয় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অরিত্রী তার বাবা-মায়ের প্রতি অপমান ও অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিফট ইনচার্জ এবং শ্রেণি শিক্ষিকা এড়াতে পারেন না। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৗসসহ অভিযুক্তদের বরখাস্ত করার জন্য গভর্নিং বডিকে নির্দেশ দিচ্ছি। একই সঙ্গে এই তিন শিক্ষকের এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না। থানাও যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে। আমি আশা করছি তারাও ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নানা কারণে নানাভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আমরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ম্যানেজিং কমিটি কিংবা সরকারি হলে তার পরিচালক, মাধ্যমিক, প্রাইমারি স্কুল, ইউনিভার্সিটি, মাদরাসা, টেকিনিক্যাল প্রতিষ্ঠান সবাইকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি, আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এটা অপরাধ। এ কারণে যারা শাস্তি পেয়েছেন তারা তো পেয়েছেনই, আর যারা করবেন তারা আরো বেশি শাস্তি পাবেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, সব শিক্ষক এ রকম নয়। ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। দরদি শিক্ষক রয়েছেন, শিক্ষার্থীকে ভালোবাসেন- এমন শিক্ষক আরো বেশি এগিয়ে আসবেন, অন্য শিক্ষককে প্রভাবিত করবেন।

একজন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে ১০ লাখ টাকাও নিয়েছে ভিকারুননিসা 

এই নামি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকরা গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। কিন্তু তার আড়ালে রয়েছে অন্ধকার জগতের সব কর্মকাণ্ড! শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অভিভাবকরা নানা ধরনের অভিযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর আমি অসংখ্য টেলিফোন পাচ্ছি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন। অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বলেছেন, তারা সাহসের অভাবে আগে বলেননি। এতে মেয়ের সমস্যা হতে পারে। একজন অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, তিনি অপদস্থ হয়েছিলেন। নাতনির জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তিনি আগে অভিযোগ করেননি। মন্ত্রী বলেন, আমরা আরো অনেকগুলো অনিয়ম, অসঙ্গতির বিষয় গার্ডিয়ান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছি। ওখানে বহু দিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটাও বড় ধরনের অনিয়ম। এর বাইরে তারা নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। আমরা জেনেছি, আগে সেখানে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে ১০ লাখ টাকাও নেওয়া হতো। আমরা শাখা খোলার অনুমোদন দেইনি, অথচ তারা শাখা খুলে ফেলে। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক তথ্য পাই, কিন্তু কোনো গার্ডিয়ান বা শিক্ষার্থী অভিযোগ করতে চান না, তারা ভয় পান। নাহিদ বলেন, অভিযোগ ছাড়া কোনো অ্যাকশন নিতে পারি না। কেউ অভিযোগ করে না।

হাইকোর্টের সুয়োমোটো নিয়ে এগোচ্ছে মন্ত্রণালয়

হাইকোর্ট এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অধিকতর তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট সুয়োমোটো এনেছেন, তারা নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এই নির্দেশ পালন করব, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে পাঁচজনের কমিটি গঠনের কাজ চলছে। এটা আমাদের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। হাইকোর্ট আমাদের গার্ডিয়ান হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের ক্ষমতা আছে আমরা পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে পারি। তবে কাজটা ওদের করতে হবে।

প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুরে শান্তিনগরের নিজ বাসা থেকে অরিত্রী অধিকারীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের পরিবারের দাবি, ফাইনাল পরীক্ষায় নকলের অভিযোগ তুলে তার বাবাকে ডেকে পাঠায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। জানানো হয়, তার মেয়েকে টিসি দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপাল অরিত্রীর সামনে তার বাবাকে অপমান করেন। বাবার এই অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়ে আত্মহত্যা করে বলে পরিবারের দাবি। মঙ্গলবার মেয়েকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অধ্যক্ষ-শিক্ষকসহ তিনজনকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা করেন অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads