• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
১৩ বছর স্থায়ী অধ্যক্ষ নেই ফলাফলেও অবনমন

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

সংরক্ষিত ছবি

শিক্ষা

১৩ বছর স্থায়ী অধ্যক্ষ নেই ফলাফলেও অবনমন

প্রভাবশালীদের খপ্পরে ভিকারুননিসা

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ১০ ডিসেম্বর ২০১৮

লম্পট শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ঘটনায় ২০১১ সালের ১২ জুলাই সেই যে পদত্যাগ করেন হোসনে আরা বেগম তারপর থেকে দেশের অন্যতম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আর স্থায়ী অধ্যক্ষ আসেননি। এর আগে ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের ১৪ জুন পর্যন্ত ছয় বছর এবং ২০১১ সালের ১৩ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে কারো কারো সুবিধা হলেও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত শুক্রবার ভিকারুননিসায় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হাসিনা বেগমকে ফের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ী কোনো অধ্যক্ষ নেই। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত, তারপর ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। একই বছরের ১৫ জুন থেকে স্থায়ী অধ্যক্ষের দায়িত্বে আসেন আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম। ওই বছরের ১৩ জুলাই শিক্ষক পরিমল জয়ধর কর্তৃক ছাত্রী ‘ধর্ষণের’ পর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অধ্যক্ষের পদ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে এসে ভারপ্রাপ্ত অবস্থাতেই ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর অবসরে যান মঞ্জু আরা বেগম। এরপর সেই বছরের ১২ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেই ২০১৭ সালের ৩ জুলাই অবসরে যান শিক্ষক সুফিয়া খাতুন। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান নাজনীন ফেরদৌস। অরিত্রীর মৃত্যুর পর আন্দোলনের মুখে বুধবার তাকে বরখাস্ত করে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। তাকেসহ তিন শিক্ষককে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছেন অরিত্রীর বাবা। সেই মামলায় এক শিক্ষক গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানে ‘খবরদারি’ করার স্বার্থে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ করা হয় না। এখানে গভর্নিং বডিই সব। তাদের কথামতো চলার জন্য অধ্যক্ষকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবেই রাখা হয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দিনকয়েক আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ওখানে (ভিকারুননিসা) বহুদিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও তারা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি, এটাও একটা বড় ধরনের অনিয়ম।

তবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার গতকাল বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য ভারপ্রাপ্ত হিসেবে একজনকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগেও ভারপ্রাপ্ত ছিল। আর আইনের মধ্য থেকেই তা করা হয়েছে। ভিকারুননিসায় কি একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হবে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরাও ভারপ্রাপ্তকে ভারমুক্ত করার চেষ্টা করছি। এর জন্য খুব তাড়াতাড়ি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের বিবাদের সুযোগে ঢাকার জেলা প্রশাসক, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের আমলা, শিক্ষামন্ত্রীর পিএস কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। এর সুবাদে এপিএস, স্থানীয় সংসদ সদস্যের পিএসরাও নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। বর্তমানে একটি নির্বাচিত কমিটি রয়েছে। সেটিও প্রভাব খাটাতে ব্যস্ত।

এ কারণে ভিকারুননিসায় পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ দেওয়া হয় না। বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক রয়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন। যথাযথ বিধান মেনে সর্বশেষ কবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। প্রভাবশালীর স্ত্রী, শ্যালক-শ্যালিকা, ছোটভাই, ছোটবোন, ভাবি- এই হলো শিক্ষক হিসেবে যোগ্যতার মাপকাঠি। এসব স্বজনের নিয়োগ দিতে প্রশ্নফাঁস, উত্তর ফাঁস, খাতা জালিয়াতি, ভাইবা বোর্ডে স্বজনপ্রীতি, কোনো সময় পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠিয়ে দেওয়ার চর্চা রয়েছে এখানে। এ ছাড়া ঘুষ দিয়েও এখানে শিক্ষকের চাকরি পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ৭০ ভাগ শিক্ষকই প্রভাবশালীদের স্বজন। এদের বিরুদ্ধেই ছাত্রী ও অভিভাবকদের যত অভিযোগ। তারা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নয়, নিছক চাকরি বা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্কুলকেন্দ্রিক শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। স্কুলড্রেস, খাতা-কলম, খাবার সাপ্লাই, শিক্ষাসফর, এসএমএস সার্ভিসসহ কয়েক ডজন খাত রয়েছে ব্যবসার। এসবের আকর্ষণেই প্রভাবশালীরা ভিকারুননিসার সঙ্গে যুক্ত হতে চান যেকোনো উপায়ে।

কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদারের কেউ পড়েন না ভিকারুননিসায়। তবুও ২০১৭ সালের এপ্রিলে তিনি কীভাবে সভাপতি হলেন- এ প্রশ্ন অনেকের। তিনি মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য। এ ছাড়া তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

বেশ কয়েকজন শিক্ষক সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিবদের আত্মীয়স্বজন হওয়ায় মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা বোর্ডে তাদের অপকর্ম নিয়ে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন। অভিযোগ করেও ফল পাওয়া যায় না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি লেখাপড়ায়ও পিছিয়ে পড়েছে। অথচ এক সময় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলে ধারাবাহিকভাবে প্রথম হতো প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ সালের এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে ভিকারুননিসা তৃতীয় হয়েছিল। ২০১৫ সালে নামে চতুর্থ অবস্থানে। ২০১৪ সালে ঢাকা বোর্ডে এইচএসসিতে পঞ্চম স্থানে ছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সেরা ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ভিকারুননিসার কেউই ছিল না। এইচএসসিতে সেরা ১০ এর মধ্যে কেবল সপ্তম স্থান ছিল ভিকারুননিসার এক শিক্ষার্থীর।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads