• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

গোপালগঞ্জ শহরে রাত ৯টা পর্যন্ত এভাবে চলছে অবৈধ কোচিং-বাণিজ্য

ছবি : গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

শিক্ষা

গোপালগঞ্জে কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা

  • গোপালগঞ্জ সদর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

গোপালগঞ্জে সরকারি স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষক জড়িয়ে পড়েছেন অবৈধ কোচিং-বাণিজ্যে। স্কুলে তারা ঠিকমতো সময় দেন না, দায়সারাভাবে ক্লাশে হাজির থাকেন, গল্প আর নিজ কোচিং-্এর মার্কেটিং করেই যেন ক্লাশ শেষ। স্কুলটাকে রিক্রিয়েশনের জায়গা মনে করেন; আর শিক্ষা দেন গিয়ে কোচিং-সেন্টারে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সকাল দুপুর বিকেল ও রাত মিলিয়ে ৩ থেকে ৫টি দু’ঘন্টার ব্যাচে তারা শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। একদিকে তারা স্কুলের দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন ১০০%; অন্যদিকে সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে অবৈধভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন কোচিং-বাণিজ্য।

আগামী ১৮ ডিসেম্বর একযোগে অনুষ্ঠিত হবে গোপালগঞ্জ শহরের স্কুলগুলোর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি-পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় জেলা শহরের তিনটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্যও ফাঁদ পেতেছেন ওইসব সুযোগ-সন্ধানী শিক্ষকরা। এজন্য গত ২৬ নবেম্বর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই তারা শুরু করেন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বিশেষ ভর্তি-কোচিং। স্কুলে সারা বছর না পড়ালেও তারা মাত্র দু’তিন সপ্তাহের বিশেষ কোচিং করিয়ে এসব স্কুলে ভর্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। এজন্য অভিভাবকদের কাছ থেকেও তারা অগ্রীম নিয়ে নিয়েছেন ব্যাচের ধরণ অনুযায়ী শিক্ষার্থীপ্রতি ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। অভিভাবকরাও সন্তানের ভাল ফলের আশায় পাল্লা দিয়ে উচ্চমূল্য নিয়ে ধাবিত হচ্ছেন ওইসব কোচিং সেন্টারের দিকে।

অবৈধ কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন শহরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে একদিন অভিযান চালায়। অনেকেই পিছন-দরজা দিয়ে পালালেও ১৮ জন শিক্ষককে আটক করা হয়। নানা নিষেধাজ্ঞা ও নির্দেশনা দিয়ে মুচলেকা নিয়ে পরে তাদেরকে ছেড়েও দেয়া হয়। কিন্তু এতে এসব কোচিং-সেন্টারে কোনও প্রভাব পড়েনি। প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী অনেকের সন্তানরাও এসব উচ্চমূল্যের কোচিংমুখী হওয়ায় ওইসব সরকারি শিক্ষকরাও কোন বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করেন না; বরং দিনে দিনে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। আর এই কোচিং প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে সাধারণ পরিবারের অভিভাবক ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তাদের এ ধরণের অনেক অভিযোগ রয়েছে ওইসব শিক্ষক ও কোচিং-সেন্টারের বিরুদ্ধে; কিন্তু সাধারণ পরিবারের হওয়ায় তারা সামনে আসতে চান না।

সিটি, জাগরণ, রাইজ, মডেল ছায়াশিক্ষা ও টিচিং নেটসহ গোপালগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি উচ্চমূল্যের কোচিং-সেন্টার রয়েছে; যেখানে গোপালগঞ্জের সরকারী এস এম মডেল গভ: হাই স্কুল ও বীণাপানি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষক এসব কোচিং-সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছেন। এছাড়াও অনেকে কোন সাইনবোর্ড ব্যবহার না করে প্রাইভেট পড়ানোর নামে ২০ থেকে ৪০ জনের ব্যাচ করে উচ্চমূল্য নিয়ে কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। রাতারাতি বনে যাচ্ছেন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। আর এসব শিক্ষকদের মদদে কোচিং-সেন্টারগুলোও হয়ে উঠছে বেপরোয়া।

মডেল স্কুলের শিক্ষক মোহম্মদ আবু হানিফ, সিকদার জাহিদ ও জাহিদুল ইসলাম, বীণাপানি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সালমা আক্তার ও মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, উত্তর গোপালঞ্জ সরকারি প্রা: বিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, এস এম মডেল গভ: প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মোঃ ইদ্রিস আলী ও পপি ম্যাডাম, ডালনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিলাস বাড়ৈ, রামচন্দ্রপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক অবিনাশ চন্দ্র বাড়ৈ, হরিদাসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহাবুব হোসেন, বীণাপানি সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিমুল হক ও রইসুল ইসলামসহ অনেকের নাম গোপালগঞ্জ শহরে অতি পরিচিত; যারা নামে-বেনামে কোচিং-সেন্টারের মাধ্যমে অথবা প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন একটু নড়াচড়া দেয়ায় শিক্ষকদের কেউ কেউ তার কোচিং-সেন্টারের সম্মুখ দরজায় তালা লাগিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পিছন দরজা ব্যবহার করে কোচিং’এর সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে জানা যায়, মডেল স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ আবু হানিফ স্কুলের সরকারী বাস ভবনে কোচিং-বাণিজ্য করছেন। তিনি তার কোচিং’এ ১৭ দিনের সাধারণ ব্যাচে ৪ হাজার টাকা এবং স্পেশাল ব্যাচে ১০ হাজার টাকা অগ্রীম ফি নেন। একই স্কুলের শিক্ষক সিকদার জাহিদ মোবাইল ফোনে বলেছেন, তার কোচিং’এ সাধারণ ব্যাচে ভর্তি-ফি ৩ হাজার টাকা; আর স্পেশাল ব্যাচে ভর্তির জন্য সরাসরি এসে কথা বলতে হবে।

শহরের মডেল স্কুলের পিছনে সাইনবোর্ড-বিহীন কোচিং-সেন্টারের প্রধান হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহাবুব হোসেন বলেছেন, তিনি সাধারণ ব্যাচে ৩ হাজার টাকা ও স্পেশাল ব্যাচে ৮ হাজার টাকা ফি নেন।

পাওয়ার হাউজ রোডের মডেল ছায়া কোচিং সেন্টারে রাত সাড়ে ৮ টায় গিয়ে দেখা যায়, তখনও কয়েকটি ব্যাচে দু’শতাধিক শিক্ষার্থী কোচিং নিচ্ছে। সাংবাদিরা গেলে কোচিংয়ের মালিক ডালনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিলাস বাড়ৈ, রামচন্দ্রপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক অবিনাশ চন্দ্র বাড়ৈসহ অন্যান্য সরকারী স্কুলের শিক্ষকরা দ্রুত সটকে পড়েন। ওই কোচিং এর শিক্ষক স্বপন জানান, তাদের কোচিং সেন্টারে সরকারী বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকসহ মোট একুশ জন শিক্ষক রয়েছেন। সারা বছরই তারা ২য় শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত কোচিং করিয়ে থাকেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থী প্রতি তারা ৪ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন।

বীণাপানি স্কুলের কাছে মধ্যপাড়ায় রয়েছে জাগরণ কোচিং সেন্টার। কোচিং এর মালিক উত্তর গোপালঞ্জ সরকারি প্রা: বিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সুকৌশলে অন্য এক শিক্ষকের নামে কাগজ-পত্র করে দীর্ঘদিন কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কোচিং’এ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি-শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৬’শ। এরা সাধারণ ব্যাচে ১৫ ’শ থেকে দু’ হাজার এবং স্পেশাল ব্যাচে ৪ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ আকরাম হোসেন ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কিশোর সাহা পৃথকভাবে একই কথা বলেছেন, সরকারি ও আধা-সরকারি কোন স্কুলের শিক্ষক কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে থাকতে পারবেন না। অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানশিক্ষক স্কুলের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে নির্ধারিত ফিস্্ নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাশের ব্যবস্থা করতে পারেন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ ’তে এসব ব্যাপারে সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেছেন, বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের যে নির্দেশণা রয়েছে তার ব্যাতিক্রম ঘটলে সেইসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, আগামী ১৮ ডিসেম্বর জেলা শহরের হাই স্কুলগুলোতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে; তবে পরীক্ষার প্রশ্ন সম্পূর্ণই বই থেকে করা হবে। বইয়ের প্রতি ধারণা যাদের আছে, তাদেরই স্থান হবে। আর সেজন্য বাচ্চাদের দিকে একটু নজর রাখলেই যথেষ্ঠ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads